বিরুপ আবহাওয়া, অপরিকল্পিত স্থাপনা, বর্ষায় পানির স্বল্পতা, মাছের অভয়ারণ্য না থাকা, পোনা মাছ নিধন, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় চলন বিলে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। সেই সঙ্গে দামও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। হিমসিম খাচ্ছেন ক্রেতারা।
নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া এবং পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা উপজেলার চলন বিল এলাকায় এখন দেশীয় প্রজাতির মাছের এমন আকাল চলছে।
চলন বিলে দেশি প্রজাতির ছোট বড় মাছ বিলুপ্তর পথে। পুকুরে দেশী মাছ চাষের চেষ্টা করলেও স্বাধ গন্ধ নেই তাতে। এক সময়ে দেশের সব চাইতে বড় মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল চলন বিল। বিলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদী ও খালগুলো ভরাট ও বন্যা না হওয়ায় এখন দেশীয় মাছের আকাল পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, নাটোর-পাবনা-সিরাজগঞ্জ জেলার নয়টি উপজেলার নিচু এলাকা নিয়ে চলন বিল অঞ্চল গঠিত। কিন্তু প্রকৃতির বিরুপ প্রভাব ও নদীর প্রবেশমুখে অপরিকল্পিত ড্যাম, স্যোতিজাল আর পলি মাটির কারণে চলন বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী খালগুলো এখন শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় নদ-নদী ও খালগুলোতে সামান্য পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে বিল শুকিয়ে যাওয়ায় দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন একেবারে কমে গেছে। এ সময় গুরুদাসপুর, সিংড়া ও তাড়াশ অঞ্চলের জেলেরা দিনভর মেহনত করেও তেমন একটা মাছ ধরতে পারছেন না। ফলে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মৎসজীবী পরিবারের সদস্যরা খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে থাকেন।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে স্বাদু পানিতে মাছের প্রজাতির সংখ্যা ২৬০। তার মধ্যে গুরুদাসপুর, সিংড়া, তাড়াশ, চাটমোহর উপজেলার চলন বিল অংশে অতীতে পাওয়া যেত প্রায় ১৩০ প্রজাতির মাছ। বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯ তে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছের প্রজাতির মধ্যে ধোঁদা, গুড়পুঁই, বাছা, ব্যাইটকা, গজার, শিলং, টেংড়া, ভেদা, শংকর, ফাঁদা, টিপ পুঁটি, পানি রুই এর মতো ১১ প্রজাতির মাছ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও, এ অঞ্চলে বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির দেশীয় মাছ। এছাড়াও মেনি মাছ, গুতুম বা পুঁইয়া, চিতল, ফোলি, চিংড়ি, ভেদা, বেলে, পাবদা, কাঁচকি, এক প্রজাতির চাঁদা, মলা-ঢেলা, দাঁড়কিনা, বৌমা, ঘাড়ুয়া, ভাঙ্গন, কালবাউশ, বাঁশপাতা, পাঙ্গাস উল্লেখযোগ্য।
গুরুদাসপুর উপজেলার বিলশা গ্রামের মৎস্যজীবী আবু তালেব, আবু বকর ও রওশন আলীসহ অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, আগে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন প্রকারের মিঠা পানির মাছ চলন বিল অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণে সংগ্রহ করতাম। বোয়াল থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, আইড়, বাইম, ঘাইরা ও টেংরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত প্রচুর পরিমাণে। এখন বিলের খালগুলো শুকিয়ে বালুর চর পড়ায় বর্তমানে মাছের দেখা মিলছে না। এতে চলন বিলাঞ্চলের হাজারো জেলে পরিবারে বর্তমানে দুর্দিন চলছে। তেমনই মাছেরও বেড়েছে দাম।
চাঁচকৈড় বাজারে আসা কলেজ শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, এখন মাছের মৌসুম তবুও বাজারে দেখা মিলছে না মাছের। আগে এ সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত দামও ছিল নাগালের মধ্যে। এখন যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে জীবনযাপন করাই কষ্ট সাধ্য। তাছাড়া ছেলে মেয়েদের খাদ্য পুষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখে অল্প কিছু দেশি মাছ কিনলাম দাম বেশি হওয়া সত্বেও।
জেলা মৎস্য অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক শহীদুল ইসলামের মতে, চলন বিলের নদ-নদীতে পলি ও বালু জমে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত পুকুর খনন, অবৈধ জালের মারাত্মক ব্যবহার, বিল ভরাট করে দখলদারিত্ব, বিষ প্রয়োগে মাছ আহরণ, বিলের গভীর অংশ সেচে মাছ ধরা, কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, মৎস্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, মাছের পর্যাপ্ত অভয়ারণ্য না থাকার কারণে চলন বিল অঞ্চল থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। সরকার দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এসব কারণে তা সফলতার মুখ দেখতে পারছে না।
এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, চলন বিল অঞ্চলে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তুলে বিলুপ্ত হওয়া মাছকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দেশে পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ ও মাছ চাষ সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। এ কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান নিয়মিত করার উপর আরও জোর দেয়া হয়েছে।
-এমএ/এমএ