এই ১০ দফাই সেই সূত্র। কিন্তু ১০ দফার প্রথম দফাতেই স্পষ্টত দেখা যায়- একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদেরসহ যেসব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে কিংবা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীসহ যেসব অপরাধী শাস্তি ভোগ করছে তাদেরও মুক্তি দিতে হবে। এবং তা হবে নিঃশর্ত। শুধু তাই নয়, যাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে সেগুলোও প্রত্যাহার করতে হবে।
তাদের প্রথম দফায় বলা হয়েছে ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নিঃশর্ত মুক্তি, সাজা বাতিল ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার নিশ্চিত করা।’ প্রথম দফায় একাত্তরের মানবতা বিরোধীদেরও কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে গেছে। দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর শাস্তি ভোগ করছে। সে জামায়াতে ইসলামির নায়েবে আমির ছিলো। একইভাবে অনেক জামায়াত নেতা বিচারাধীন আছে একই অপরাধে। এই দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে মানবতা বিরোধী অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্তদের তো মুক্তি দিতেই হবে এরপর আর জামায়াতের কোনো নেতা কর্মীকে বিচারের আওতায়ও আনা যাবে না।
অন্যদিকে যে দল ও জোটগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গঠনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী অন্যতম। শুধু তাই নয় এই ১০ দফা প্রস্তাব উত্থাপনের আগে বিএনপি মহাসচিব ঘোষণা করেছেন, বৃহত্তর ঐক্য হবে জামায়াতকে ২০ দলে রেখে। সুতরাং জামায়াতে ইসলামির অভিযুক্ত ও অপরাধী নেতাদের মুক্তি ও শাস্তি বাতিলের বিষয়টিও এই প্রস্তাবের আওতায় আসছে।
কুরবানীর ঈদের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেগম জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করেন। সাক্ষাৎশেষে ওই রাতেই তিনি বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান- ২০ দলীয় জোটে জামায়াতকে রেখেই তারা সমমনা অন্য দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ছেন। অর্থাৎ জামায়াতকে রেখেই তারা ড. কামাল হোসেন, ডা. বি চৌধুরী ও বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। এটা শনিবারের কথা। অবশ্য বিএনপির এই বক্তব্যের পর যুক্তফ্রন্ট নেতাদের কারো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। জানা যায়নি ড. কামাল হোসেন তাঁর ৭২ এর সংবিধানকে সামনে রেখে ঐক্যের শর্ত থেকে সরেছেন কিনা কিংবা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জান্নাতেও যেতে না চাওয়ার ঘোষণা থেকে সরে এসেছেন কিনা।
প্রশ্ন আসে, আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত কোনো অপরাধীর সাজা বাতিল কি সরকার করতে পারে? বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের মামলা থেকে মুক্তি দিতে হবে। তাহলে ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় বিচারাধীন বন্দী ও অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরও মুক্তি দিতে হবে। পলাতক রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলোও প্রত্যাহার করতে হবে। যে তারেক জিয়াকে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আনার দাবি করা হচ্ছে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য সেই তারেক জিয়াকেও নির্দোষ ঘোষণা দিয়ে সপ্রনোদিত দেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
তাদের দাবির চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রকে দলীয়করণের ধারার বদলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা’ একইভাবে দশম দফায় বলা হয়েছে, ‘ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসনের প্রতিষ্ঠা।’ স্পষ্টত প্রশ্ন আসে একাত্তরে মানবতা বিরোধীদের মুক্তি দেওয়া, তাদের বিচার বন্ধ করা এবং তাদের শাস্তি বাতিল করার মতো অস্বাভাবিক ও স্বাধীনতা বিরোধী আবদার কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার উদাহরণ হতে পারে? একইভাবে ‘রাষ্ট্রের সর্বস্তরে কি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এর মাধ্যমে?
অন্য প্রস্তাবগুলোও যদি আলোচনায় আসে, তাহলে বিএনপির নিজের বিচারও নিজেকেই করতে হবে। পাশাপাশি তাদের দ্বারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে কিনা সেই সন্দেহেরও অবসান করতে হবে। এই প্রসঙ্গে তৃতীয় দফায় উল্লেখিত ‘সব রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসান’ আলোচনায় আসতে পারে। আর সেই বিষয়টি স্পষ্টতই ব্যাখ্যা চাইতে পারেন, বিকল্প ধারার প্রধান ডা. বি চৌধুরী। কতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিতারণ করা হয়েছিলো, প্রতিহিংসার শিকার চৌধুরী সাহেব কি ভুলে গেছেন সেই স্মৃতি? যারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও তাদের দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে অপদস্ত করে তাড়িয়ে দিতে পারে, সেই দলটি কী করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কথা বলে হা হুতাশ করতে পারে?
মঙ্গলবার গণফোরামের বৈঠকে বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে আলোচনা হবে। গণফোরামের নেতা ড. কামাল হোসেন যিনি জাতির জনকের সহচরই শুধু নন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক এবং বাংলাদেশের সংবিধানেরও অন্যতম প্রণেতা। তিনি কি স্বাধীনতা বিরোধী ও একাত্তরের মানবতা বিরোধীদের মুক্তিকে সমর্থন করবেন? তিনি দেশের প্রথম সারির আইনজীবীও। তিনি কি সায় দেবেন ২১ আগস্ট হত্যা মামলার অপরাধিদের বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবকে?
আদালতে সাজাপ্রাপ্তদের সাজা বাতিল এবং হত্যাকাণ্ড ও হত্যাপ্রচেষ্টায় জড়িতদের বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে যে ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার’ প্রস্তাব করা হয়েছে, তাও কি ড. কামাল হোসেনের মতো বিজ্ঞ আইনজীবী মেনে নিয়ে জামায়াতে ইসলামির মতো চিহ্নিত মানবতা বিরোধী ও সন্ত্রাসী দলের মিছিলে যোগ দেবেন?
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম’ও কি সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভিনব প্রস্তাবকে মেনে নেবেন? স্ববিরোধী বক্তব্যে ভরা ১০ দফা কি হতে পারে বৃহত্তর ঐক্যের যোগসূত্র। সেই সূত্র কতটা শক্তিশালী হবে তাও দেখার বিষয়।
লেখক- সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক।