শুধু শিক্ষার আলো ছড়ানোর ক্ষেত্রেই নয়, বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্যও সুপরিচিত দেশের উচ্চশিক্ষায় দ্বিতীয় প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। প্রতি বছর শীতকালের শুরুতেই ৭৫৩ একরের ক্যাম্পাসটির বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা যায় নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখির অবাধ বিচরণ।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্যাম্পাসে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। সাধারণত বর্ষার শেষে এবং শীতের শুরু থেকেই এসব পরিযায়ী পাখির দেখা মিলতো রাবি ক্যাম্পাসে। চলতি মৌসুম জানুয়ারির মাঝামাঝিতেও ক্যাম্পাসে পাখির আনাগোনা তেমন চোখে পড়েনি।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের খালেদা জিয়া, তাপসী রাবেয়া ও রহমতুন্নেছা হলের পেছনের চামপঁচা পুকুর, রহমতুন্নেছা হলের পাশের পুকুর, মানচিত্র পুকুর, কৃষি অনুষদ ভবনসংলগ্ন পুকুরসহ বেশ কয়েকটি জলাশয়ে দেখা যেত পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এসব পরিযায়ী পাখির বিচরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের পুকুরগুলো লিজ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে, যেখানে মাছচাষিরা পাখিদের আগমন রোধে দড়ি টানানো হয়েছে। আবার বোতলের মধ্যে কিছু মার্বেল পুরে বোতল দাঁড়িতে বেঁধে রাখা হয়েছে, যা পাখিদের জলাশয়ে নামতে বাধা দিচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি পুকুর ভরাট করে ২০ তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন, দুটি আবাসিক হল ও একটি শিক্ষক কোয়ার্টারের কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হল নির্মাণের জন্য খালেদা জিয়া, তাপসী রাবেয়া ও রহমতুন্নেছা হলের পেছনের চামপঁচা পুকুর ভরাট করা হয়েছে। যেই পুকুরে প্রতিবছর পরিযায়ী পাখিরা সবচেয়ে বেশি ভিড় জমাতো। এদিকে, পরিযায়ী পাখি না আসার জন্য ক্যাম্পাসে বিভিন্ন উৎসব, নির্মাণকাজের উচ্চ শব্দ, মানুষের অবাধ যাতায়াত, যানবাহনের শব্দ এবং আলো দূষণকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাখি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতের মৌসুমে উত্তরের সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন এবং হিমালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকার দেশগুলো থেকে উষ্ণ জলবায়ু এবং খাদ্যের সন্ধানে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আসে। এদের মধ্যে বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির দেখা মেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বড় সরালি হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস, ভূতি হাঁস, ঝুঁটি হাঁস, বালিহাঁস ইত্যাদি।
শামিম হাসান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, রাবিতে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই বড়ভাইদের কাছে শুনতাম শীতের সময় ক্যাম্পাসে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে। তবে এ ক্যাম্পাসে আসার দুই বছর পার হলেও পাখি তেমন একটা চোখে পড়েনি। এ কারণে পরিযায়ী পাখিদের জলকেলির মনোরম দৃশ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
ক্যাম্পাস সংলগ্ন বুথপাড়া এলাকার আতিয়ার রহমান সাত বছর বয়সী নাতি আবিদুর রহমানকে পরিযায়ী পাখি দেখাতে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছিলেন। তবে বড় কোনো জলাশয়ে পাখি দেখতে পারেননি। জানতে চাইলে আতিয়ার রহমান বলেন, চার-পাঁচ বছর আগেও ক্যাম্পাসে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসত। তখন জলাশয়গুলোর পাশে দাঁড়ালেই পাখির হাক-ডাক ও খেলাধুলা চোখে পড়ার মতো ছিল। কিন্তু এখন পাখিদের সেইসব দৃশ্য চোখেই পড়ছে না।
ক্যাম্পাসে পশু-পাখি নিয়ে কাজ করা রাবি সেভ ওয়াইল্ডলাইফ এন্ড ন্যাচারের সভাপতি ইমরুল কায়েস বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাখি না আসার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আবাসস্থলের অভাব। বিগত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসের অনেক শতবর্ষী ও বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া জলাশয়গুলো বিভিন্ন কারণে ভরাট করা হচ্ছে। তাই পাখিরা থাকার মতো জায়গার অভাবে ভুগছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের দূষণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাখি শিকার পরিযায়ী পাখি কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া পাখিদের আবাসস্থলের দিকে মানুষের বেশি আনাগোনাও পরিযায়ী পাখি কমে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ।
পরিযায়ী পাখি নিয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ্ রেজার সাথে। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ মানুষের নানা কার্যকলাপ, যা তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্যাহত করছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণের জন্য গাছ কাটা হচ্ছে। জলাশয় ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। পুকুর বা জলাশয়গুলো মাছ চাষের জন্য লিজ দেওয়া হচ্ছে, যা পাখিদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলকে ব্যাহত করছে। জলাশয়ে মাছ চাষের কারণে পাখিদের খাদ্যের প্রাপ্যতা কমে গেছে।
পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, মানুষের কার্যক্রম পাখিদের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নির্মাণকাজ একটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলে পরিযায়ী পাখিদের ওপর। পুকুর লিজ দিয়ে যে মাছ চাষ হয়, তখন পানিতে ন্যাচারাল ওয়াটার বডি থাকে না। আবার পাখিরা যেন বসতে না পারে সেজন্য দড়ি দিয়ে রাখে, যা পাখিদের জলাশয়ে নামতে বাধা দিচ্ছে। আমাদের জলাভূমিগুলো কমে যাওয়ার কারণে পাখিদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে যে শেখ হাসিনা হল হয়েছে, এ জায়গায় একটি পুকুর ছিল। ওই পুকুরে অনেক পরিযায়ী পাখি আসতো। পুকুরটা ভরাট করাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, পাখি না থাকার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে লাইট (আলো)। যে অঞ্চলটায় আলো থাকে, সাধারণত পরিযায়ী পাখিরা ওই অঞ্চলটা পরিত্যাগ করে চলে। পরিমাণের তুলনায় বেশি আলো থাকার কারণে রাতের বেলা পোকামাকড়গুলো বের হয় না, এর ফলে পাখিদের খাদ্য সংকটে ভুগতে হয়। রাজশাহীতে যে এত পরিমাণে লাইটিং হয়েছে, তার কারণে আশেপাশে গাছগুলোতে যে পাখিগুলো ঘুমাতো, আলোর জন্য তারা বাসস্থান চেঞ্জ করে, কারণ তারা তো অন্ধকার চায়।
এফএ/আরএন/এসআর