সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, ৫ আগস্টের পর দেশে অন্যরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ১৫-২০দিন দেশের কোথাও পুলিশের ভূমিকা দেখা যায়নি। পুলিশের অনুপস্থিতিতে আমরা ওইসময় মুসলমানরা হিন্দুদের মন্দির পাহারা দিয়েছি। আমরা নিজেরা নিজেদের মহল্লা পাহাড়া দিয়েছি, আমরা নিজেরা নিজেদের পাশে দাড়িয়েছি। এটাই মূলত বাংলাদেশ, এটাই বাংলাদেশের স্প্রিড। আমাদের পাশের দেশে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোষরা মন্দিরে হামলা করার পরিকল্পনা করেছিল। সেই হামলার চক্রান্ত আমাদের দেশের মানুষ রুখে দিয়েছে। ফলে সেই চক্রান্ত সফল হয়নি।
শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন আয়োজিত মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হেলাল উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা, জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার, সোনারগাঁও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা রহমান।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার। এসময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থী উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টা বলেন, দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সংস্কৃতির বৈচিত্র রক্ষায় সরকারের নানা পরিকল্পনা রয়েছে। লোক কারু শিল্পের শিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য সারা বছর যাতে প্রদর্শন ও বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়। সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। পানামনগর আমাদের মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। পানাম নগরী ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্ট করার জায়গা। পানাম নগরের পুরনো জরাজীর্ণ ভবনগুলো কিভাবে সংস্কার করা যায় সেটি নিয়েও কাজ করবে মন্ত্রণালয়। পানাম নগরের হেরিটেজ সংরক্ষণ করে ফেলে রাখলে সেগুলো আবার নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এসব স্থাপনা সংরক্ষণের পর হ্যারিটেজ মিউজিয়াম ও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উপদেষ্টা আরো বলেন, সারাদেশে সংস্কৃতি উৎসব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ঘটছে সেটা আমরা অস্বীকার করছি না। পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা নিয়ে এসব ঘটনার সমাধান করা হবে। বাংলাদেশ বৈচিত্রের জায়গা, বৈচিত্র রক্ষার্থে সরকার কাজ করবে।
আবহমান গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্য বাংলাদেশ লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিবছরই মাসব্যাপী লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব আয়োজন করেন। ১৯৯১ সাল থেকে নিয়মিতভাবে মাসব্যাপী এ লোকজ মেলার আয়োজন করে ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৫জন কারুশিল্পীকে সম্মাননা ও স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি কোমড় তাঁত শিল্পে নিলাম চিসিন, সোনারগাঁয়ের হাড়িঘোড়া ও মমি পুতুল শিল্পে বীরেন্দ্র চন্দ্র সূত্র ধর ও কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের টেপা পুতুল শিল্পে সুনীল পালকে এক ভরি স্বর্ণ পদক, এক লাখ টাকার চেক ও সম্মাননা দেওয়া হয়। এছাড়াও শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন আজীবন সম্মানা দেওয়া হয় সোনারগাঁয়ের নকশি কাঁথা শিল্পে হোসনে আরা ও কুমিল্লার তামা কাঁসা শিল্পে মানিক সরকারকে। তাদের দেড় ভরি স্বর্ণ পদক, তিন লাখ টাকা চেক ও সম্মাননা দেওয়া হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ময়ূর পঙ্খী মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত পরিবেশিত হয়। পরে অতিথিরা মেলা চত্বর ঘুরে দেখেন।
মাসব্যাপী এবারের মেলায় কর্মরত কারুশিল্পী প্রদর্শনী, লোকজ প্রদর্শনী, পুতুল নাচ, বায়স্কোপ, নাগরদোলা, গ্রামীণ খেলাসহ বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে। প্রতিদিন লোকজ মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ খেলা, লাঠিখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, কর্মরত কারুশিল্পীর কারু পণ্যের প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
ফাউন্ডেশন সূত্র জানা যায়, এবারের মেলায় কর্মরত কারুশিল্পী প্রদর্শনীর ৩২ টি স্টলসহ ১শটি স্টল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৬৪জন কারুশিল্পী সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে। সোনারগাঁয়ের জামদানী, মৌলভীবাজার ও মুন্সিগঞ্জের শীতল পাটি, মাগুরা ও ঝিনাইদহের শোলাশিল্প, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি ও মৃৎশিল্প, কক্সবাজারের শাঁখা ঝিনুক শিল্প, রংপুরের শতরঞ্জি, ঠাকুরগাঁয়ের বাঁশের কারুশিল্প, কাঠের চিত্রিত হাতি- ঘোড়া-পুতুল, কুমিল্লার খাদিশিল্প, তামা-কাঁসা-পিতলের কারুশিল্প, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কারুশিল্প, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা পুতুল, বগুড়ার লোকজ খেলনা ও বাদ্রযন্ত্রসহ বিভিন্ন কারুশিল্পীরা মেলা অংশ নেবেন। মেলায় প্রতিদিন লোকজ মঞ্চে বাউলগান, পালাগান, লোক সংগীত শিল্পীদের পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালী, জারিসারি, হাসনরাজা, লালন, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণের গান, লালন সঙ্গীত, ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গম্ভীরা, আলকাপ, পুথিপাঠ, উকিলমুন্সী, লোকজ নৃত্যনাট্য, চর্যাগান, লোকগল্পবলা ও মাইজভান্ডারীসহ বিভিন্ন ধারার লোকগীতি অনুষ্ঠিত হবে।
এইচএমআর/এসআর