বাংলা সনের ভাদ্র মাস পড়তেই শুরু হয় শরতের কাঁশফুলের দোল দেয়া হাওয়া। মেঘের ঘোমটার আড়ালে থাকে মায়া ছড়ানো পৃথিবীর তৃতীয় পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। অনেক সময় মেঘের ঘনঘটা সরে হঠাৎ দৃশ্যমান হলেও থাকে সময়ের স্থায়ীত্ব। যার কারণে হাওয়ার তোড়ে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে আবার।
শ্রাবণের মেঘের শেষ হতেই ভাদ্রের শুরুতেই কাটতে থাকে ভারি মেঘের আবরণ। পরিস্কার হতে থাকে দিগম্বর আকাশ। শুভ্র মেঘের পালে মিশে যায় সাদা কাঁশবনের রূপ। ঋতু চক্রে বিভিন্ন রঙ বদলায় পরিবেশ প্রকৃতি। তাই তো সাদা মেঘের ঘোমটা আড়ালেই উঁকি দিতে শুরু করেছে জাদুকরী রূপের মায়াবি কাঞ্চনজঙ্ঘা।
শরৎ আর হেমন্ত ঋতু দিয়েই শুরু হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার মোখ্যম সময়। মেঘমুক্ত আকাশে দেখা মিলতে শুরু করে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা। শরতের শুরুতেই খোঁজখবর রাখতে শুরু করেন তৃষিত পর্যটকরা। বার বার দেখলেও তৃষ্ণা না মেটায় এমন পর্যটকরা ছুটেন এই পৃথিবীর যুগল পর্বতের রূপ দেখার। এ দৃশ্য কাছ থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের উত্তরের হিমালয় কন্যাখ্যাত জেলা পঞ্চগড়ে। এ জেলার দেশের মানচিত্রের উত্তরকোণে তেঁতুলিয়ায় গেলেই নয়ন জুড়িয়ে দেখার সুযোগ মেলে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার অবস্থান?
কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালয় পর্বতমালার পর্বতশৃঙ্গ। মাউন্ট এভারেস্ট ও কেটু’র পরে এটি পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। যার উচ্চতা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার (২৮ হাজার ১৬৯ ফুট)। এটি ভারতের সিকিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত। হিমালয় পর্বতের এই অংশটিকে কঞ্চনজঙ্ঘা হিমাল বলা হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা মাউন্ট এভারেস্টের ১২৫ কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এটা হিমালয়ের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ। পাঁচটি পর্বতচূড়ার কারণে একে ‘তুষারের পাঁচটি ঐশ্বর্য’ বলা হয়। সিকিম এবং দার্জিলিংয়ের স্থানীয় লোকেরা একে পবিত্র মনে করে পূজা করে। সর্বোচ্চ উচ্চতার এই দৈত্যাকার পর্বতের দেখা পেতে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ খরচ করে ভারতের সিকিম ও নেপাল ভ্রমণ করে থাকেন লাখ লাখ পর্যটক।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সেরা সময় ও কোথা থেকে দেখা যাবে
সাধারণত শীতকালে দূরের মেঘমুক্ত আকাশে যেন ভেসে থাকতে দেখা যায় তুষারশুভ্র পাহাড়ের চূড়া। রোদের আলোয় চিকচিক করতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই মোহনীয় শোভা উপভোগ করার জন্য শীতই সবচেয়ে সেরা সময়। পাহাড় চূড়ার প্রাকৃতিক দৃশ্যটি সারা দিনের ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রুপ ধারণ করে। তাই বছরের যেকোনো সময় না গিয়ে অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টাতে যাওয়া উত্তম। এই সময়টাতে আকাশ একদম পরিষ্কার থাকে। মেঘের সঙ্গে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার লুকোচুরি খেলার কোনো উপায় থাকে না।
সকাল ৮টা থেকে সূর্যকিরণ যখন তেজ বাড়তে থাকে তখন স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। সকাল ১০টা পর্যন্ত বেশ ভাল দেখা যায়। তারপর আস্তে আস্তে ঝাপসা হতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। শেষ বিকেলে সূর্যকিরণ আবার যখন তির্যক হয়ে পড়ে বরফ পাহাড়ে তখন অপূর্ব মহিমায় অন্যরূপে ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। সকাল ৬টা থেকে ১০টা এবং বিকেল ৪টা থেকে ৫টা এই সময়ে মধ্যে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন না থাকলে বরফে আচ্ছাদিত শুভ্র পর্বতের সাক্ষী হতে পারবেন।
এছাড়া, উপজেলার বিভিন্ন স্থানের ফাঁকা জায়গায় দাড়ালে খুব ভোরে মেঘ ও কুয়াশামুক্ত নীল আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোরম দৃশ্য পর্যটকদের খালি চোখেই এঁকে দেয় বিস্ময়ের চিহ্ন।
পঞ্চগড় থেকে কেন এতো কাছে?
দেশের উত্তরের এ জেলার ত্রিমুখী ঘিরে রেখেছে প্রতিবেশি দেশ ভারত। ভারতের সেভেন সিস্টারের প্রধান ফটক তেঁতুলিয়া। এখানে রয়েছে দেশের একমাত্র চার দেশিয় স্থলবন্দর। যেখান থেকে যাওয়া যায় ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীন। তবে এ রুটে চীনের সাথে বাণিজ্য না থাকায় চার দেশিয় ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থল হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব এ স্থানটির। এ স্থলবন্দর থেকে ভারতের শিলিগুড়ির দূরত্ব ৮ কিলোমিটার, দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটার, এভারেস্ট শৃঙ্গের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার ও কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব মাত্র (আকাশ পথে) ১১ কিলোমিটার। আর নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার, ভুটানের দূরত্ব ৬৪ কিলোমিটার ও চীনের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। পর্যটন শিল্পখ্যাত ভারতের ভারতের সিকিম, দার্জিলিং, নেপালের হিমালয় ও ভুটানের ডুয়ার্সের মতো পর্যটন অঞ্চলে যাওয়া যায় এ রুট দিয়ে। এ কারণে এখান থেকে এভারেস্টের দূরত্ব কম থাকায় বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় কাছ থেকে দেখা মেলে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াকাড়া বর্ণিল রূপ।
কেন এতো কাছে টানে পর্যটকদের?
ভোরের সূর্য উঠার আগেই ঘুম ভাঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষদের। দীর্ঘকাল ধরেই ঘুম ভাঙা চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। প্রতিদিন দেখার কারণে আকর্ষণ না থাকলেও তারা পর্যটকের কাছে তুলে ধরেন কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ সৌন্দর্যের চমৎকার বর্ণনা। তারা জানান, আকাশ পরিস্কার থাকলে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার বিরল সৌন্দর্য। ভোরে উষায় রক্তিম রোদ কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর যেন ঠিকরে পড়ে। সূর্যের কিরণের তেজ বাড়তে থাকলে দেখা মেলে হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিন্ন ভিন্ন মায়াবী রুপ। একই অঙ্গে অনেক রূপ এই কাঞ্চনজঙ্ঘার। প্রথমে কালচে, এরপর ক্রমান্বয়ে টুকটুকে লাল, কমলা, হলুদ এবং সাদা রং ধারণ করে। ভোরের প্রথম কিরণ কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া স্পর্শ করে তখন শ্বেতশুভ্র এই পর্বতটি হয়ে ওঠে উত্তপ্ত লাভার মতো লাল। রোদের তেজ বাড়তে থাকলে মিলিয়ে যেতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। শেষ বিকেলেও আরেকবার দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
স্থানীয়রা জানান, এ অঞ্চলের সীমান্তজুড়ে প্রবাহিত হয়েছে মহানন্দা নদী। এ নদীর ওপারেই বিস্তৃত ভারত। এপারে তেঁতুলিয়া শহরের একমাত্র পর্যটন কেন্দ্র ডাকবাংলো পিকনিক কর্ণার। এখান থেকেই স্পষ্ট ভাবে অবলোকন করা যায় বহল কাংখিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাহাড়ের চূড়া ছাড়াও সন্ধ্যায় এখান থেকে ভারতের কালিম্পং শহরের যানবাহন চলাচল, বৈদ্যুতিক আলো, দার্জিলিংয়ের মহকুমা সদর দপ্তর ও রাতে প্রদর্শিত ভারতের সীমান্ত বাহিনীর ওয়াচ লাইট উপভোগ করা যায় ডাকবাংলোর তীর থেকে। আর বিস্তীর্ণ চা বাগানের সবুজ গালিচার মধ্যে সোনার আলোয় উদ্ভাসিত হয় এর নৈসর্গিক রূপ। এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে দৃশ্যমান হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে ছুটে আসেন অসংখ্য পর্যটক।
পর্যটক সেবা প্রতিষ্ঠান তেঁতুলিয়া ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম, নর্থবেঙ্গল ট্যুরিজম, কারিঘরের সদস্যরা জানান, হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা যুগল পর্বতশৃঙ্গ দেখতে প্রতি বছর লাখো পর্যটক ভারত ও নেপালে গিয়ে থাকেন। সেই পবর্তশৃঙ্গকে কাছ থেকে দেখা যায় দেশের একমাত্র উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এলে। গত ০৮ সেপ্টেম্বর কিছু সময় দেখা গিয়েছিল। মেঘ কাটতে শুরু করেছে। সামনে নিয়মিত দেখা যাবে। এ জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ফোনে ও ফেসবুক, হোয়াটঅ্যাপস ও টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগামাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগ করছেন। যখনই দেখা যাবে তখন যেন আমরা তাদেরকে জানিয়ে দেই।
কাঞ্চনজঙ্ঘার বিধৌত রূপ-সৌন্দর্য ছাড়াও তৃষিত দৃষ্টি জুড়াবে সীমান্ত অববাহিকার নানা দৃষ্টিনন্দন দর্শনীয় স্থান। ঐতিহাসিক ডাকবাংলো পিকনিক কর্ণার, সমতলের চা বাগান, আকাবাঁকা নদী, পাথর, পাথরের জাদুঘর, দক্ষিণ এশিয়ার দূর্গ নগরী, ইংরেজ আমলের স্থাপত্য ও পুরাকীর্তি, সুফীদের বার আউলিয়া মাজার শরীফসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। আর বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী আইসিপি পয়েন্টে বিজিবি-বিএসএফের জয়েন্ট রিট্রিটের নান্দনিক প্যারেড প্রর্দশন। এক ভ্রমণেই কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ এসব দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার সুযোগ আছে পর্যটকদের।
পর্যটকদের জোরদার নিরাপত্তায় তৎপর রয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোন, থানা পুলিশ ও প্রশাসন।
ট্যুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাজেদুর রহমান জানান, পঞ্চগড় একটি শান্তিপূর্ণ পর্যটন এলাকা। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকেই এখানকার পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখার। তাই পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদাই ট্যুরিস্ট ও মডেল থানা পুলিশসহ প্রশাসন তৎপর রয়েছেন। পর্যটকরা এখানে এসে নির্বিঘ্নে দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়াবেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বী জানান, প্রতি বছর শরৎ-হেমন্ত ঋতুতে দেশের একমাত্র উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় রূপ উপভোগ করতে প্রচুর পর্যটকরা ছুটে আসেন। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও থাকার ব্যবস্থা হিসেবে রেস্ট হাউজ প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি পর্যটক সেবা প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে।