বিশাল পাতিলে ধবধবে সাদা চালের গুড়া আর পানির মিশ্রণ। সামনে চুলায় দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। গরম কড়াইতে চালের গুড়ার মিশ্রণ দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা। এরপর সঠিক সময়ে হয়ে যাওয়া পিঠা ওঠানোর পালা। ঠিক এভাবেই একের পর এক পিঠা বানাতে ব্যস্ত পটুয়াখালীর দশমিনায় রাস্তার পাশের পিঠা বিক্রেতারা।
শীত আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই উপজেলা শহরের ফুটপাতগুলোতে বসেছে হরেক রকমের পিঠার দোকান। বিভিন্ন অলিগলিতে সড়কের পাশে পিঠার পসড়া নিয়ে বসেছেন কয়েকশ মৌসুমী দোকানিরা। গ্রামবাংলার এসব ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নিতে সকাল-সন্ধ্যায় দোকানগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন মানুষ। অল্প দামে এসব পিঠা পেয়ে খুশি ক্রেতারাও।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা সদরের প্রায় প্রতিটি সড়কের মোড়ে বসেছে অস্থায়ী পিঠার দোকান। চিতই, ভাপা, ডিম চিতই, ডিম চটাসহ চালের গুড়ার তৈরী নানা বাহারী পিঠার পসরা সাজান দোকানিরা। শুটকী, চিংড়ির ভর্তা, ধনেপাতা ভর্তা, খেজুর গুড়সহ নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজনও থাকছে এসব পিঠার সঙ্গে।
উপজেলা সদরের নলখোলা বাসষ্ট্যান্ড এলাকার পিঠা ব্যবসায়ী সাবিকুন্নাহার (৪০) নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস পিঠা বিক্রি করেন। সবাই যখন ঠান্ডায় কাবু হয়ে জবুথবু অবস্থা তখনও সাবিকুন্নাহারের ১ সেকেন্ডের জন্যও থাকেনা অবকাশ। সন্ধ্যার পর থেকেই চলে তার পিঠা বানানোর ধুম। এ পিঠা তৈরী করেই সংসার চলে তার। প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার টাকার পিঠা বিক্রি করেন তিনি। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পরে তার ধোঁয়া ওঠা চিতই, ডিম চিতই, ডিম ভাজা চটার জন্য।
তিনি বলেন, 'স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই জীবন জীবিকার প্রয়োজনে পিঠা বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চালাই। দুই সন্তান রয়েছে আমার। ছেলে সজিব দশমিনা সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ও মেয়ে সাহারা দশমিনা সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বৃদ্ধ শ্বশুড়-শাশুড়ির দেখাশুনাসহ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার সকল খরচ পিঠা বিক্রির ওপর নির্ভরশীল।'
চাম্পা বেগম উপজেলা পরিষদ এলাকায় একজন ক্ষুদ্র চা ব্যবসায়ী। বছর জুড়ে টঙ দোকানে চা বিক্রি করলেও শীত এলেই চায়ের পাশাপাশি বিক্রি করেন পিঠা। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে এ বিক্রি। তিনি বলেন, 'প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টাকার পিঠা বিক্রি করি। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাসের পিঠা বিক্রির আয়েই মূলত সারা বছর চলে আমার সংসার।'
চালের গুড়া, গুড় ও নারিকেলের মেলবন্ধন করতে করতে হাসিমুখে সবার কাছে পিঠা তুলে দিচ্ছিলেন উপজেলা সদরের হাজীরহাট লঞ্চঘাট এলাকার মৌসুমী পিঠা ব্যবসায়ী কাজল রেখা। তার কাছে পিঠা বানানোর মতো সহজ কাজ আর কিছু নেই। আর শীতের সময় একটু গরম উষ্ণতা পেতেই পিঠা খেতে ভিড় করেন ঢাকা ও চাঁদপুরগামী লঞ্চ যাত্রীসহ স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
জানা যায়, চার-পাঁচ মাসের জন্য চলা ফুটপাতের এই ভাসমান পিঠার দোকানগুলো অনেকের পুরো বছরের আয়ের উৎস।
উপজেলা সদরের নলখোলা বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় পিঠা কিনতে আসা শারমিন বলেন, 'শীতের পিঠার সঙ্গে গ্রামের সম্পর্ক প্রায় পুরোটাই। কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনে শীতের এই পিঠার আয়োজন গ্রামীণ আবহে মানুষকে নিয়ে যায় স্মৃতির জানালায়। শহরের ইট-পাথরের ভিড়ে নতুন ধান, খেজুর রস আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবুও নিরন্তর এই ছুটে চলায় অবসর মেলে না প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে একটু খানি শীতের পিঠার স্বাদ নেয়ার। সত্যি অন্যরকম এক সুযোগ করে দিয়েছেন মৌসুমী পিঠা ব্যবসায়ীরা।
লঞ্চঘাট এলাকায় পিঠা খেতে আসা ঢাকাগামী যাত্রী জাহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রামীণ মানুষের একান্নভুক্ত পরিবার জীবন জীবিকার প্রয়োজনে ভেঙে গেছে। শহরের মানুষগুলো সময়ের অভাবে গ্রামে যেতে না পারায় পিঠা পুলির স্বাদ নিচ্ছেন ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে। পিঠা বিক্রি বিক্রেতার কাছে পেশা হলেও ক্রেতাদের কাছে এ যেন উৎসব। এই পেশা ও উৎসবের বন্ধন শহুরে জীবনে এনে দেয় গ্রামীণ পরশ।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক উন্মেষ রায় ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'পিঠা উৎসবের সঙ্গে জড়িত রয়েছে কৃষিকেন্দ্রিক বাঙালির জীবন ব্যবস্থা। নতুন ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা আবার নতুন বৎসরে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্নের আনন্দে তারা নতুন ধানের চালে পিঠা-পুলি-পায়েস বানিয়ে স্বজন প্রতিবেশি নিয়ে আয়োজনে শামিল হত। কিন্তু সেই কৃষকদের উত্তর প্রজন্মের অনেকেই জীবিকার তাগিদে শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়। শহরের ব্যয়বহুল জীবনযাপনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে তারাই সারা দিনের কাজের শেষে পরিবার নিয়ে নেমে যায় রাস্তার ধারে পিঠা বানাতে। এভাবে একদিকে প্রান্তিক মানুষের জীবিকার সমান্তরালে শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষজন গ্রামীণ সংস্কৃতির স্পর্শ পায়। যা হাজার বছরের কৃষি নির্ভর শ্রমশীল বাঙালি সংস্কৃতির শিকড়কে বাঁচিয়ে রাখে। তখন জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি আর জীবনাচরণ একসূত্রে গ্রথিত হয়।