করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে বিপর্যস্ত
রাজশাহী। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। পরিস্থিতি সামাল দিতে সারা দেশেই চলছে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’। তবে লকডাউনের ভেতর মহানগরীতে নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ চলছে। উন্নয়নকাজের জন্য গ্রাম থেকে শহরে ঢুকছেন শ্রমিকেরা কিন্তু তাঁদের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন গরজ নেই। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
লকডাউনের কারণে মহানগরীর তিন প্রবেশমুখে রয়েছে পুলিশের চেকপোস্ট। এসব চেকপোস্ট পেরিয়ে সকালে দলবেঁধে শ্রমিকেরা বাইসাইকেল নিয়ে শহরে ঢুকছেন। কাজ শেষে বিকালে আবার ফিরছেন একইভাবে। এ সময় বেশিরভাগ শ্রমিকের মুখেই মাস্ক দেখা যাচ্ছে না। কারও মাস্ক থাকছে থুতনিতে, কারও পকেটে আবার কারও মাস্ক ঝুলছে সাইকেলের হ্যান্ডেলে।
বৃহস্পতিবার মহানগরীর উপকণ্ঠ বিনোদপুর এলাকায় কিছু সময় দাঁড়িয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। বাইসাইকেল নিয়ে ওই পথে জেলার পুঠিয়া উপজেলা থেকে শ্রমিকেরা কাজের জন্য শহরে আসেন এবং ফিরে যান। ১০ থেকে ১৫ জনের দল হয়ে শ্রমিকেরা সাইকেল চালিয়ে গেলেও দু’একজনের মুখেই মাত্র মাস্ক দেখা গেছে। বাকিরা দিব্যি চলছেন মাস্ক ছাড়া। দিনভর শ্রমিকেরা যখন বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন, তখনও তাঁদের মাস্ক পরার সুযোগ হচ্ছে না। এতে ঝুঁকি আরও বাড়ছে। এসব শ্রমিকদের মাধ্যমে করোনা শহর থেকে গ্রামে ছড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শ্রমিকদের একটি দলে ছিলেন পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর গ্রামের শ্রমিক রবিউল ইসলাম। তাঁর কাছে পুরনো মলিন একটা সার্জিক্যাল মাস্ক ছিল। সেটি ঝুলছিল বাইসাইকেলের হ্যান্ডেলে। রবিউলকে দাঁড় করিয়ে মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে বললেন, মাস্ক পরলে সাইকেল চালানোর সময় নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। তাই পরেননি। রবিউল জানালেন, পাঁচটাকায় চারদিন আগে মাস্কটা কিনেছেন। তারপর থেকে নিজের কাছেই রেখেছেন। মাঝে মাঝে মুখে তোলেন। বাকিটা সময় এভাবে সাইকেলের হ্যান্ডেলেই ঝোলেন।
রবিউল এখনও বিশ্বাস করেন, তাঁদের মত ‘পরিশ্রমী’ গ্রামের মানুষের করোনা হবে না। মাস্কটা রেখেছেন শুধু পুলিশের ভয়ে। চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় তিনি মাস্ক পরেন। রবিউলের সঙ্গে ছিলেন একই এলাকার শ্রমিক সুলতান হোসেন। তাঁর কথা, ‘করুনা তো আইজক্যা আসেনি। তাও ম্যালা দিনই হয়্যা গেল। কিছু হলে এতদিনে হয়ে যেত। গরীবের করোনা হয় না।’
রবিউল ও সুলতানের কথা প্রসঙ্গে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘এ কথা তো অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি। কিন্তু শ্রমিক-গরীব মানুষের সে কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে কেউ বাঁচতে পারছেন না। এখন হাসপাতালে যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন, তাঁর অর্ধেকেরও বেশির বাড়ি গ্রামে।’
মহানগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালী এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, মাস্ক না পরেই শ্রমিকেরা বাইসাইকেলে চড়ে পুলিশের চেকপোস্ট পার হচ্ছেন। তবে এক শ্রমিক সামনে পুলিশ দেখে পকেট থেকে মাস্ক বের করলেন। এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে অন্য হাতে মাস্কটা পরলেন। তারপর পুলিশের চেকপোস্ট পার হলেন। ওই শ্রমিককে দাঁড় করিয়ে জানা গেল, তাঁর নাম কুরবান আলী। বাড়ি পুঠিয়ার ঝলমলিয়া এলাকায়। কুরবানও জানালেন, তাঁর কাছেও যে সার্জিক্যাল মাস্ক সেটি তিন দিনের পুরনো। গ্রামের মুদি দোকান থেকে তিনিও এটি কিনেছেন পাঁচ টাকায়।
রাজশাহীর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. চিন্ময় কান্তি দাস বলেন, ‘একটা সার্জিক্যাল মাস্ক একবারই পরা যায়। একবার পরে খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সেটির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। সেটি পরে আর কোন লাভ নেই।’
শ্রমিকেরা একটা সার্জিক্যাল মাস্কই কয়েকদিন ধরে পরছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে এসব মাস্ক পরে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে বরং কাপড়ের তৈরি মাস্ক পরলে লাভ আছে। মাস্ক পরতে হবে মানুষ জানে তবে মাস্ক কীভাবে ও কতক্ষণ পরবেন? সে বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম কম হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কাজ করে মানুষকে সচেতন করতে হবে। নইলে সংক্রমণ কিন্তু কমানো কঠিন।’
আরএইচএফ/এসআর