কনিষ্ঠ কন্যার মেরুদণ্ডে স্পন্ডলসিস বা ডিস্ক প্রলাপ্সের সমস্যা দেখা দেয় ২০১৬ সালের কোনো এক সময়ে। কন্যা সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কোমর থেকে তীব্র যন্ত্রণা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নেমে আসে। আমি তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। কন্যাকে নিয়ে নিউরো, স্পাইন এবং অর্থপেডিস্ক বিশেষজ্ঞদের কাছে ছুটাছুটি করছি। একসময়কার দিকপাল নিউরো সার্জন প্রফেসর রশিদ উদ্দিনকেও মেট্রাপলিটন বেসরকারী হাসপাতালে গিয়ে দেখালাম। এক্সরে, সিটি স্ক্যান ফিল্ম ও রিপোর্ট দেখে অন্য সকলের মত তাঁরও অভিন্ন অভিমত, সার্জারি লাগবেই। ভেঙ্গে পড়লাম। সার্জারি যে নিরাপদ নয় তা জানতাম। একজন নিকট শুভাকাঙ্খি এ্যাপোলো হাসপাতালের নিউরো বিশেষজ্ঞ ডা. ম্যাথিউ চ্যান্ডিকে দেখিয়ে পরামর্শ নিতে বললেন। অভিন্ন পরামর্শ। সার্জারি অনিবার্য।
ভাবলাম, সার্জারি যদি করতেই হয় ভারতে গিয়ে করানো যায় কিনা। সেসময় চেন্নাইতে অর্থপেডিক্স সার্জারিতে প্রশিক্ষণরত আমার ভাগ্নে ডা. রাকিব মনঞ্জুরকে খোঁজ নিয়ে ভারতে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন চিকিৎসকের নাম জানাতে বললাম। নয়া দিল্লির ইন্ডিয়ান স্পাইনাল ইনজুরিজ সেন্টারের ডা. এইচ. এস. চাবরার নাম সে জানাল। ওয়েবসাইটে গিয়ে যোগাযোগ করলাম। এ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম। কাল বিলম্ব না করে কন্যাকে নিয়ে স্বস্ত্রীক সার্জারির জন্য সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা ও প্রস্তুতি নিয়ে দিল্লি পৌছালাম। সেন্টারে কন্যাকে ভর্তি করানো হল। সন্নিহিত একটি আবাসিক ডরমিটরিতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল।
পরদিন ডা. চাবরা রুগিকে দেখলেন। আমরা ডা. চাবরাকে দেখলাম। বুক ধুক ধুক করছিল। মাথায় পাগড়ি পরিহিত শিখ ধর্মাবলম্বী ডা. চাবরা একজন তরুণ চিকিৎসক। ভদ্র, বিনয়ী ও আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি কেবল এক্সরে ফিল্ম ও রিপোর্ট দেখলেন। রুগিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বললেন এবং ধীরে ধীরে সামনে নুইয়ে পা ছুঁতে বললেন। অনায়াসে সে তা করতে পারল। ডা. চাবরা বললেন ওর সার্জারি-চিকিৎসা কিছুই লাগবে না। প্রতিদিন একঘন্টা সোজা হয়ে হাটবে। ধৈর্য রাখতে হবে। আপনা আপনি সেরে উঠবে। আমরা যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল নিয়ে দেশে ফিরে এলাম। পরবর্তী দু’মাসে কন্যা ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ সুস্থ হল। সেথেকে আজ পাঁচ বছর। লেখা-পড়া শেষ করে অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সপ্তাহে সাত দিনই সে কাজ করছে। ডা. চাবরার জন্য প্রাণভরা আশির্বাদ। তিনি দীর্ঘজীবী হয়ে মানুষের সেবা করুন। কন্যার জন্য নিরন্তর প্রার্থনা, অবশিষ্ট জীবন যেনো সুস্থ থাকে।
পুরোনো এই স্মৃতি চারণার হেতু আছে। এ্যাড. কারামত প্রচুর লেখা-পড়া করা জ্ঞানপিপাসী একজন মানুষ। পেশায় রয়েছে সততা ও নিষ্ঠা। এ’কারণে তাঁর সাথে আমার হৃদ্যতার সম্পর্ক। সেদিন লগডাউনের এক অন্তহীন অলস প্রহরে দেশে ও ভারতে চিকিৎসা সেবার বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতায় প্রবৃত্ত হয়েছিলাম। চিকিৎসা ব্যাপদেশে দেশের বড় বড় সব বেসরকারী হাসপাতালের পাশাপাশি তিনি ভারতের অনেক সেরা সেরা হাসপাতালে গিয়েছেন। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে দেশের বড় বড় নামি-দামি কতিপয় বেসরকারী হাসপাতালে অসহায় রোগিদের প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কতিপয় কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে ভারতের বড় বড় হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসকদের নৈতিকতার প্রশংসা করছিলেন।
এ্যাড. কারামতও আমার কন্যার অনুরূপ ২০১২ সালে মেরুদণ্ডের স্পন্ডলিয়সিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বড় বড় সব হাসপাতাল-চিকিৎসক শেষ করে সর্বশেষ এ্যাপোলো হাসপাতালের ডা. ম্যাথিউ চ্যান্ডিকে দেখালেন। তিনিও বললেন সার্জারি ছাড়া বিকল্প নেই। অবশেষে তিনি স্থির করলেন ভারতে গিয়েই সার্জারি করাবেন। এ্যাম্বুলেন্স, সেট্রচার, হুইলচেয়ারের সাহায্য নিয়ে বিমানে চেপে স্বস্ত্রীক ভারতের তামিলনাড়ু–র ভেলরে গেলেন। সেখানে খ্রিষ্টান মেডিকেল কলেজ এ্যান্ড হসপিটালে স্পাইনাল কর্ড বিষয়ক বিশেসজ্ঞ চিকিৎসক ডা. রহিত অমিতত্র্যান্ডের সাথে দেখা করলেন।
ডা. রহিত তিনদিন ধরে সময় নিয়ে রোগিকে বিভিন্নভাবে উঠিয়ে বসিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন। শেষদিন জানতে চাইলেন সার্জারির খরচের টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছেন কিনা। কারামত জানালেন দশ হাজার ডলার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। বাকি টাকার ব্যবস্থা করা যাবে। ডা. রহিত স্মিত হাসলেন। নিউরো-বি এবং যন্ত্রণা উপশমের জন্য কয়েকটা ট্যাবলেট দিলেন। ক'দিন বাদে আরেকবার দেখা করতে বললেন। কারামত ঔষধ সেবন করলেন। দীর্ঘদিন পর পরম তৃপ্তিতে দু/তিন দিন গভীর নিদ্রা হল। যন্ত্রণা নেই। একাই ওয়াশরূমে যেতে পারলেন। চার/পাঁচ দিনে প্রায় ৯০% সুস্থ হয়ে চিকিৎসকের সাথে দেখা করলেন। চিকিৎসক সহজ কয়েকটা দৈহিক ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যবিধির পরামর্শ দিলেন। হাসপাতাল ও ব্যবস্থাপত্রের বিল হয়েছিল পঁচিশ ডলারের কম। সে থেকে আজ অব্দি পরিপূর্ণ সুস্থ।
বাংলাদেশের বেসরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রশংসনীয় অনেক দিক রয়েছে। সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকরা অনেক দক্ষ। তারা প্রায় সকলেই বিকেলে-রাতে চেম্বার করেন। বাড়তি কিছু অর্থ আয় করেন। তাৎক্ষণিক প্রচুর সংখ্যক রোগিকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ্য করেন। দেশেও অনেক মাঝারি মানের বেসরকারী হাসপাতাল রয়েছে যেখানে প্রতারণা-বিহীন সেবা পাওয়া যায়। এদেশেও টি.এ. চৌধুরী, গোলাম রসুল, ব্রিঃ মালেক, এম. আর. খানের মত নিষ্ঠা, নৈতিকতা, ও সৎ পেশাদারিত্বের আইকন চিকিৎসকরা ছিলেন। প্যানডেমিকের এই ক্রান্তিকালে বাৎসরিক জন প্রতি আয় ৯% বর্ধিত হওয়া সতের কোটি মানুষের দেশে ঔসব চিকিৎসকদের অনুকরণ করা আজ নিছক বোকামি হবে! আমার আয় ২০% কমেছে। অনেকের আয় ৯০০০% বেড়েছে। পুঁজিবাদে এটাই বাস্তবতা।
ইউরোপ-আমেরিকা-অষ্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসা সেবায় প্রতারণার কৌশল একেবারেই নেই। তবে সে-সব দেশে চিকিৎসকের সাথে আগাম এ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। এক/দেড় মাস পর এ্যাপয়েন্টমেন্ট মিলে। সে অনেক বিড়ম্বনা। বাংলাদেশে রাতারাতি সরকারী বা বেসরকারী চিকিৎসকের দ্বারস্ত হওয়া সম্ভব। তবে পুঁজিবাদি তত্ত্বে ভর করে অধুনা যেসব বিশাল বিশাল চাকচিক্যময় মুনাফালোভী হাসপাতালগুলো গড়ে উঠেছে সেগুলোতে প্রতারণা ও অপচিকিৎসা নিতান্ত কম নয়। রবি ঠাকুরের ভাষায় ‘পাকা চোর অতিশয়।’ চিকিৎসা হবে পেশা, ব্যবসা নয়। যৌক্তিক পারিশ্রমিকের পাশাপাশি সেবার মানবিকতাবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়। আধুনিক চিকিৎসা যেনো সেখানে সেবা নয়, কেবল মুনাফার জন্য রমরমা ব্যবসা।
মৃত্যুর পরও রোগিকে ভেন্টিলেশন বা আইসিউতে কয়েকদিন আটকে রেখে বিল করা, হৃদযন্ত্রে রিং না পরিয়েই রিং পরানো হয়েছে বলে বিল করা, কিডনি ও পিত্তথলির পাথর অপসারণ না করেই বিল করা, ব্যবহৃত হয়নি এমন সব ব্যয়বহুল ঔষধের উল্লেখ করে বিল করা, মরার উপর খাঁড়ার ঘা’র মত অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে অনেক টাকা হাতিয়ে নেয়া, এমন অজস্র সব অভিযোগ শোনা যায়। এতসব অভিযোগ সর্বাংশে সত্য না হলেও, অসত্য নয়।
আমি নিজে একবার এমনি এক বনেদি হাসপাতালে আমার এক নিকট আত্মীয়ের স্ফীত বিল নিয়ে বাহাছ করতে গেলে বিল ম্যানেজার আমাকে ধমকে বলেন, আপনি চোখে দেখেন না আমাদের হাসপাতালের স্ট্যান্ডার্ড ফাইভ ষ্টার হোটেলের চেয়েও বেশি। খাপছাড়া তুলনায় আমি বিষ্মিত হলাম। হাসপাতালে রুগি আসে উত্তম চিকিৎসা পেতে। ভালো আহার করতে কিংবা নরম বিছানায় আয়েশ করে ঘুমাতে নয়। সমাজতন্ত্রের রাজনীতি বা চর্চা উঠে গেছে। কার্ল মার্ক্সের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এখন আলোচিত হয় না। রবিনহুড কাল্পনিক চরিত্র। বাস্তবের চারু মজুমদার ও সিরাজ সিকদাররাও ধৃত ও মৃত। নক্শাল নেই। সর্বহারা নেই। কাজেই ভয় নেই। যথেচ্ছ মুনাফা অর্জনের সকল সড়ক আজ উন্মুক্ত। অবারিত সুযোগ। অবাধ স্বাধীনতা। তথাপি জনস্বার্থে খানিকটা হলেও রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ এখন কাঙ্খিত।
লেখকঃ প্রাক্তন সিনিয়র সচিব
E-mail:
[email protected]