যে ২১ জন উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে ইউজিসি, গণমাধ্যম বলছে, বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই মূল অভিযোগ নিয়োগে দুর্নীতি। শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে দুর্নীতি যত সহজে চোখে পড়ে, উপাচার্য নিয়োগে ‘অন্য’ বিবেচনা কি ততটা আলোচনায় আসে?
দুটো ঘটনা বলি।
প্রথমটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। ২০১২ সালের ঘটনা। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। ৯ জানুয়ারি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ খুন হন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে। ছাত্রলীগের এই নেতা-কর্মীরা তখন ‘উপাচার্যপন্থি’ হিসেবে ক্য়াম্পাসে পরিচিত ছিলেন।
এরপর থেকেই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি অংশ আন্দোলন শুরু করেন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে। অন্য একটি অংশ অবস্থান নেন উপাচার্যের পক্ষে। ঘটনা এতটাই তিক্ত হয়ে ওঠে যে, সাংস্কৃতিক জোটের আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলাতেই কেবল ঘটনা থেমে থাকেনি, হামলা হয়েছে শিক্ষকদের ওপরও। এমনকি শিক্ষকদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে।
তখনই আন্দোলনের এক পর্যায়ে উপাচার্যের বাসভবনের একটি গেটে অবস্থান নিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, অন্য গেটে তাকে মুক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে অবস্থান নেন তার পক্ষের শিক্ষকেরা। সংবাদ সংগ্রহে গেলেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে অনেক পরিচিত মুখই দুই পক্ষেই ছিলেন।
প্রথম মেয়াদে নিয়োগ পেয়ে করেছিলেন স্বজনপ্রীতি। মেয়ে এবং মেয়ের জামাইকে চাকরি দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে ১৪১ জনকে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উপাচার্য । এই নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞাও উপেক্ষা করা হয়েছে। অভিযোগ, ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন নিয়োগ দিতে।
সে সুবাদে ক্যামেরার পেছনের অনেক গল্পও জানা হয়েছিল তখন। অনেক সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষককেই দেখেছি তারা উপাচার্যের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হলেও উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, তাদের নিয়োগ তখনও সিন্ডিকেটে চূড়ান্ত হয়নি। নানা শর্ত সাপেক্ষে তারা নিয়োগ পেয়েছেন। একইভাবে বেশিরভাগ শিক্ষকই সত্যিকার অর্থে হত্যার বিচার চাইলেও, অনেকের মূল লক্ষ্য ছিল নিজের পছন্দের লোককে নিয়োগ না দেয়ায় তৎকালীন উপাচার্যকে বিপদে ফেলা।
এই আন্দোলনে উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের ভাগ্যে কী ঘটবে সেটা শেষ পর্যন্ত ঠিক করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে পদত্যাগ করতে ‘বলা হয়’।
এরপরও অন্তত আরো দুইবার উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। শরীফ এনামুল কবিরের জায়গায় উপাচার্য নিয়োগ দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে। মাত্র দুই বছর পরই তাকে আন্দোলনের মুখে সে দায়িত্ব ছাড়তে হয়। দেশের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধেও উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এমনকি খোদ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব, উপাচার্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টিও তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমেও উঠে এসেছিল।
এবার অবশ্য উপাচার্যের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। তাকে তো পদত্যাগ করতে হয়ইনি, বরং দ্বিতীয়বার তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। উলটো তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগেরও অনেকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ধস নামে।
দ্বিতীয় ঘটনা গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের। তার দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক ফাতেমা তুজ জিনিয়াকে বহিষ্কার করে প্রশাসন। এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বশেমুরবিপ্রবি ছাড়াও দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। জিনিয়ার সঙ্গে তখন থেকেই সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকার কারণে শিক্ষক নিয়োগে বিপুল অনিয়মের বিষয়ে জানার সুযোগ হয়েছিল।
জিনিয়া বলছিলেন, কিভাবে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক বিবেচনা ইত্যাদি কারণে নানা শর্ত শিথিল করে দেড়শর বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। এসব ক্ষেত্রে ‘অধিকতর যোগ্যতা’ থাকলে শর্ত শিথিল করার সুযোগকেও ইচ্ছেমতো কাজে লাগানো হয় বলেও মনে করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- ইউজিসির নিয়মিত এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তা হয়ে ওঠে কেবল আন্দোলন শুরুর পরই।
দেশের ৮ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে- খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বেগম রোকেয়া, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে শেষের দুটির সাবেক এবং প্রথম ৬টির বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
এছাড়া আরো ১৩ উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে ইউজিসি। মোট ২১ উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত। এছাড়া কারও বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপরাধের অভিযোগও আছে। আইনে সংশোধন ও শর্ত শিথিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্য়ালয়ের উপাচার্য়ের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়োগ ইস্যুটি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত। আবার নিয়োগ শেষ করে আগের জায়গায় আইন ফিরিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও প্রকাশিত হয়ে গণমাধ্যমে।
অন্য সব জায়গার মতোই বিশ্ববিদ্য়ালয়ও খুব সহজসরল নীতি দিয়েই চলার কথা। মেধার ভিত্তিতে ভর্তির সুয়োগ পাবে শিক্ষার্থীরা। এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী-শিক্ষক এবং উপাচার্য বা অন্য প্রশাসনিক নিয়োগ হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে। কিন্তু সে অবস্থা অনেক আগেই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। উপাচার্য নিয়োগ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিচালনার চেয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়। আর সে ক্ষমতা ক্যাম্পাসে টিকিয়ে রাখতে উপাচার্যও নিজের মতো শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে থাকেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে কখনো ছাত্রলীগ, কখনো ছাত্রদলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেন।
নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মে অনেকের ‘চোখ বুঁজে’ থাকার আরেকটি কারণও রয়েছে বলে আমি মনে করি। স্বাধীনতার আগে-পরে এবং নানা ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও বিশ্ববিদ্য়ালয়গুলোই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশজুড়ে এই পাওয়ারহাউজ বা শক্তিকেন্দ্রগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখাও ক্ষমতাসীনদের জন্য বড়ই প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাটাই কি গৌণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে? সূত্র: ডয়েচে ভেলে।
-এনএন