বরগুনার বেতাগী বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব পাশে বেতাগী-মির্জাগঞ্জ সড়কে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠেছে মাতৃছায়া জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেবার নামে এখানে চলছে গলাকাটা রমরমা বাণিজ্য।
এখানে প্রসূতি মায়েদের সিজার করার সময় একাধিক শিশু ও মায়ের মৃত্যুর খবরও রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ টাকা খরচ করেও উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জানা যায়, বরগুনার বেতাগী পৌর শহরে বাস স্ট্যান্ডের পূর্ব পাশে ২০১৮ সালের মে মাসে মাতৃছায়া জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি বেসরকারি হাসপাতাল চালু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই হাসপাতালটি চালু করেন এর মালিক আবুল বাশারের পরিচালনায়। তিনি ইচ্ছামতো নিয়ম-কানুন তৈরি করে বছরের পর বছর রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। নেওয়া হচ্ছে ইচ্ছামাফিক ফি। হাতুড়ে টেকনিশিয়ানরা অনেক ক্ষেত্রেই দিচ্ছেন মনগড়া রিপোর্ট। চিকিৎসক না হয়েও পরিচালক আবুল বাশার নিজে অপারেশন করেন।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে তাদের ছত্রছায়ায় এ অবৈধ অনুমোদনবিহীন হাসপাতাল চলছে।
বেতাগী সদর ইউনিয়নের ভোলানাথপুর গ্রামের বাসিন্দা সানজিদা পারভিন সিমু বলেন, 'আমার বাবাকে কিছু দিন আগে এ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করি। ভালো চিকিৎসা না পেয়ে বরিশালের শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে (শেবাচিমে) ভর্তি করানোর পর সুস্থ হয়।'
বেতাগী বাস স্ট্যান্ডের হোটেল ব্যবসায়ী শওকত হোসেন বলেন, 'হাসপাতালের মালিক আবুল বাসার নিজে অশিক্ষিত। মাত্র ফাইভ পাস করেছেন। অথচ নিজেই সিজার করে একাধিক নবজাতক মেরে ফেলেছেন।'
তিনি আরও বলেন, পরিচালক আবুল বাশার ও তার স্ত্রী, তার ৯ম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে এবং তার ৭ম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে মিলে সিজার করছেন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এরা ভুল রিপোর্ট দিয়ে রোগীদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। রোগী অন্য কোথাও পূর্ণ রিপোর্ট করে সেটি প্রমাণিত হলে অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় দফারফা করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এই হাসপাতালে কোন জরুরি বিভাগ, নেই রোগ নির্ণয়ের মানসম্মত যন্ত্রপাতি, পরীক্ষাগার বা টেকনোলজিস্ট। মাঝে মধ্যে ধার করা পার্টটাইম চিকিৎসক দিয়ে চলে জটিল অপারেশনসহ নানা চিকিৎসা। কম বেতনের অনভিজ্ঞ নার্স, আয়া ও দারোয়ানই হচ্ছে এ হাসপাতালের একমাত্র ভরসা। কম্পিউটারাইজড, পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ও অত্যাধুনিক নামে নামিদামী চিকিৎসকদের নাম সংবলিত চোখ ধাঁধানো ব্যানারসহ ডিজিটাল সাইনবোর্ড সর্বস্ব এ হাসপাতালে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য এসে অপচিকিৎসার জালে আটকা পড়ছেন। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত সহজ-সরল অসহায় মানুষগুলো প্রতিনিয়তই তাদের পাতা ফাঁদে আটকে নিঃস্ব হচ্ছেন।
এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসার কথা মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করে বলা হলেও তাদের কেউ কেউ মাসে দু-একবার এসে অপারেশন করে চলে যান। এখানে নিয়মিত কোন চিকিৎসক থাকেন না। এসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম ভাঙিয়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। জেলা কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনিটরিং কিংবা জবাবদিহি না থাকায় অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।
মাতৃছায়া জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক আবুল বাশারের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করতে চাইলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পদে দায়িত্বে থাকা সোহাগ হাওলাদার বলেন, পরিচালক আবুল বাশার গত তিন সপ্তাহ যাবৎ বরিশাল গেছেন। ফোন কেন বন্ধ করে রেখেছে এ বিষয় আমি কিছু বলতে পারবো না।'
তবে হাসপাতালের বিষয়ে মালিকের অনুমতি ছাড়া তিনি কোন তথ্য দিতে চাননি।
বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথ সরকার বলেন, 'বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।'
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তেং মং বলেন, 'বেতাগীতে ৫টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এদের দুটিতে লাইসেন্স থাকলেও মাতৃছায়া জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোন কাগজপত্র নেই। এ অবৈধ হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সুহৃদ সালেহীন বলেন, 'এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করে দেখবো। অপরাধমূলক কোন কাজ করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
-এমএ