ভাগ্যদোষে সার্টিফিকেট শুধুই কাগজ |
![]() শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে হেনস্থার কমতি নেই সহপাঠি কিংবা শিক্ষকের কাছে। তাও যদি পার হয়, চাকরির ক্ষেত্রে ভয়েস কিংবা বডি ল্যাংগুয়েজ দেখেই বাতিলের সিল পড়ে ভবিষ্যতের দরজায়। তাদের জন্য কোন শিক্ষা কিংবা চাকুরির কোটা নেই। এভাবেই মেধা থাকা সত্বেও চাঁদা তুলে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের অনেক শিক্ষিত বেকারকে। রংপুরের ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাফিজুল ইসলাম রনি, তৃতীয় লিঙ্গের হয়েও রংপুর সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সিজিপিএ ২.৯৭ পেয়ে অনার্স শেষ করেছে। এসএসসিতে তিনি জিপিএ ৪.৪৪ ও এইচএসসিতে জিপিএ ৪.৪২ পেয়ে পাশ করে। ইতোমধ্যেই চাকরির জন্য দরখাস্ত করেন এনজিও ও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলেও ভাইভা বোর্ডে কেবলমাত্র ভয়েসের কারণে তাকে ফেরত আসতে হয়েছে বার বার এমনই অভিযোগ রনির। রনি বলেন, ভাইভা বোর্ডে আমাকে ওনারা বলেন আমি নাকি মেয়ের মতো কথা বলি। এ জন্য তাদের কাজে সমস্যা হবে। মানুষ নাকি আমাকে দেখে হাসবে। তাই তারা আমাকে রিজেক্ট করে। আমার কি দোষ, আমি তো নিজে থেকে এমন হইনি। আমি অনেক টাকা পয়সা চাইনা। আমি চাঁদা তুলে, ভিক্ষা করে খেতে চাইনা। আমার কন্ঠস্বর না দেখে আমার যোগ্যতায় চাকরি দিন। বেতন ১০ হাজার হলেও চলবে। অন্তত আমার বাবা-মা আমাকে বোঝা তো ভাবতে পারবে না। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় টিউশনিতে কম হেনস্থা হতে হয় না বলে জানেিয়ছেন তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন। ‘আমি এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.৯৬ পেয়ে পাশ করেছি। এখন মানবিক বিভাগে পড়ছি। কিন্তু আমাকে কেউ প্রাইভেট পড়াতে চায়না। আমি তো টাকা দিয়েই পড়বো, ফ্রি তো পড়তে চাইনি। আমাকে সুযোগ দিলে আমিও সমাজের আর ১০ জনের মতো বড় হতে পারবো। কিন্তু আমাকে সুযোগ দিচ্ছে না এই সমাজ।’ মনের দুঃখ এভাবেই প্রকাশ করেন তৃতীয় লিঙ্গের এক সদস্য পপি সরকার। কর্মক্ষেত্রে একই কাজ করে পারিশ্রমিক কম কিংবা অন্যান্যদের থেকে অর্ধেক পান বলে জানান অনেকেই। তৃতীয় লিঙ্গের আরেক সদস্য সাকিব বলেন, ‘আর্থিক সমস্যার কারণে এসএসসির পর আর পড়িনি। রংপুরের জাহাজ কোম্পানীতে এক দোকানে ছিলাম। কিন্তু হিজড়া হওয়ায় আমাকে আমার কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেয়া হয়নি। একই কাজ করে অন্যজন পেয়েছে মাসিক ৮ হাজার টাকা, আমাকে দেয়া হয়েছে ৪ হাজার টাকা। যাকে ৮ হাজার টাকা দেয়া হয়, সে মানুষ, তার ক্ষুধা আছে আমার কি ক্ষুধা নাই? আমি কি অপরাধ করেছি? সরকারের কাছে আমার অনুরোধ আমাদের কর্মসংস্থান তৈরি করে দিন। দরকার হলে আমাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করুন।’ সুযোগ পেলেই মেধা পরিচয় দিতে পারবে বলে দাবি তাদের। অনেকেই স্বপ্ন দেখেন সরকারি দপ্তরে চাকরি করার। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই হেনস্থা হতে হয় তাদের। আনোয়ার হোসেন নামের একজন বলেন, ‘আমি আর্মিতে দাঁড়িয়েছিলাম, প্রথমদিকে টিকে যাই। এরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় আমাকে বাদ দেয়া হয়। একজন আমার সামনে বলেছেন হিজরাদের কোন চাকরি হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি সরকারি ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে দেশের উন্নতি করতে চাই। আমি ভাল ভাবেই সেবা দান করবো। সরকারের কাছে আমার বিশেষ মিনতি আমাকে একটি সরকারি চাকুরি দেবেন।’ ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল শেষ করে চাকরির সন্ধান করছেন সহিদ হোসাইন (শ্রাবণ)। তিনি অবজারভারকে বলেন, ‘আমি তৃতীয় লিঙ্গের বলে চাকরি হচ্ছে না। সবাই আমাকে হিজড়া বলে। আমি মানুষের কাছে হাত পেতে চলতে চাইনা। আমরা চাকরি বোর্ডে ভাইয়া দিতে গেলেও বৈষম্যের শিকার হই। আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙ্গে দেয়া হয়। আমাদের সঙ্গে ভাল আচরণ করা হয় না। আমি আগে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার অনুরোধ জানাবো। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলেই সবকিছু ঠিক হবে বলে আমি মনে করি।’ রংপুরের ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থার সদস্য ৩৭২ জন। এছাড়াও রংপুর বিভাগে হাজারেরও বেশি তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবার দিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার আহ্বান জানান শ্রাবণ। সমাজ সেবার আওতাধীন সামাজিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রের আওতায় ২০১৯ সালে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের ১০ জন সদস্য। কর্মদক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে ৫০ দিনব্যাপী তাদেরকে শেখানো হয়েছে এমএসওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্ট। ট্রেইনার জ্বিলহাজ্জ্ব উদ্দিন জনি বলেন, ‘এরা মেধাবী। কাজে লাগালে ভাল করতে পারবে। খুব কম সময়ে এরা সহজেই শিখে যায়।’ আরেক প্রশিক্ষক মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ওরা ২ ব্যাচে শিখে গেছে। ৫০ দিন খুব কম সময়। আমরা এমএসওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্টের পাশাপাশি আরও কিছু শেখাচ্ছি। যা তাদের কাজে লাগবে।’ এছাড়াও বিউটিফিকেশনে ট্রেইনিং নিয়েছে ১৪ জন ও ২৬ জন দর্জিতে। সামাজিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রের আওতাধীন ৫০ দিনের কর্মসূচিকে অনেক কম সময় হিসেবে মনে করেন তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই। এ কর্মসূচির সময় আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রুবেল দলীয় নাম মাধবী বলেন, ‘এই সময়টা অনেক কম, ভবিষ্যতে আরও সময় বাড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করছি। কেবল ট্রেইনিং দিলেই হবে না, মনিটরিংয়েরও ব্যবস্থা করতে হবে।’ সমাজ সেবার আওতাধীন সামাজিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রের উপ-তত্বাবধায়ক বেগম নাহিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘ওরা প্রচন্ড মেধাবী, অল্পতেই শিখে যায়। আমরা দুই বার তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের ট্রেইনিং দিয়েছি। ওদের সুযোগ দিলে আরও এগিয়ে যেতে পারবে। ভবিষ্যতে আরও বেশি সদস্যকে ট্রেইনিং দিতে পারবো বলে আশা করছি।’ সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘আমরা তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের দু’বার ট্রেনিং দিয়েছি। ওরা কম্পিউটার, বিউটিফিকেশন, রান্না ও সেলাইয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। ট্রেনিং শেষে তারা যাতে কিছু করতে পারে তাই ১০ হাজার করে টাকাও তাদের হাতে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।’ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের এসব ট্রেনিং প্রাপ্তরা, এই প্রশ্নের উত্তরে তৃতীয় লিঙ্গ দলনেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানা বলেন, ‘১০ হাজার টাকা দিয়ে হয়তো একটা সেলাই মেশিন হতে পারে, কিছু কসমেটিক হতে পারে। কিন্তু ব্যবসার জন্য তো একটা জায়গার প্রয়োজন আছে। সেটা আমরা পাবো কোথায়, আমাদের টাকাও নেই, আর কেউ আমাদের সেই ব্যবসার জায়গাও দেয়না। তাই সত্যিকার অর্থে এই ট্রেনিংগুলো কোন কাজ লাগছে না।’ এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আসিফ আহসান বলেন, ‘ফিক্সড কর্মটা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং, তাদের কাছ থেকে কোন আইডিয়াও আসে না। তারা অবশ্য বিউটিফিকেশন, সেলাই ও রান্নাতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ভবিষ্যতে তাদের কর্মসংস্থান তৈরিতে আমরা আরও কাজ করবো।’ -এমএ |