নওগাঁর রাণীনগরে সনদপত্র টেম্পারিং (মিশ্রিতকরণ) করে জন্মের এক বছর আগেই দাখিল পাশ ও জন্মের এক বছর পরেই আলিম পাশের সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এই সনদপত্র জালিয়াতি করে দীর্ঘদিন যাবৎ অবৈধ ভাবে নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাজ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন কাজী বেলাল হোসাইন।
কাজী বেলাল অর্থের বিনিময়ে জালিয়াতি করা সার্টিফিকেট দাখিল করে আইন মন্ত্রণালয় থেকে নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজীর) লাইসেন্স বাগিয়ে নেয়। এ নিয়ে রাণীনগর থানায় একটি মামলা হওয়ার পর (মামলা নং-০৬, তাং ২২-০২-২০০৫, ধারা-৪৬৬/৪৬৭/৪৭১/৪২০/৩৪ দঃবিঃ) চার্জশিট দাখিল হয়। সেই মামলা এখনও চলমান রয়েছে।
বিভিন্ন অভিযোগ থেকে জানা যায়, রাণীনগর উপজেলার ৫ নং বড়গাছা ইউনিয়নের গহেলাপুর গ্রামের নাজিম উদ্দীনের ছেলে মো. বেলাল হোসাইন। রাণীনগর আল-আমিন দাখিল মাদ্রাসা থেকে পাশের সনদ অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারী ১৯৮৪ সাল। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স (কাজী হতে হলে সরকারি বিধি মোতাবেক নূন্যতম বয়স ২১ বছর) না হলেও ২০০৩ সালে কিভাবে কাজীর লাইসেন্স পায় বেলাল হোসাইন তা নিয়ে সচেতন মহলে রীতিমতো হৈ চৈ পড়ে গেছে।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, আল-আমিন মাদ্রাসার রেকর্ডপত্র অনুসারে বেলাল হোসাইনের জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারি ১৯৮৪। কিন্তু জন্মের আগেই ১৯৮৩ সালে দাখিল ও জন্মের এক বছর পর ১৯৮৫ সালে আলিম পাশ করার সদনপত্র দাখিল করে কাজীর লাইসেন্স বাগিয়ে নেয়। উপজেলার মালঞ্চি গ্রামের মৃত ময়েন উদ্দীনের ছেলে রাণীনগর আল-আমিন দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক বেলাল উদ্দীন বগুড়ার কাহালু উপজেলার মাগুড়া এম.ইউ সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৩ সালে দাখিল ও ১৯৮৫ সালে আলিম পাশ (ক্রমিক নম্বর-১৪৬৬৪, রেজি নম্বর-১২৩২৬, শিক্ষাবর্ষ-১৯৮৩-১৯৮৪) করে রাণীনগর আল-আমিন দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। আর এই শিক্ষকেরই দাখিল ও আলিম পাশের সার্টিফিকেট সুকৌশলে সংগ্রহ করে টেম্পারিং (ঘষামাজা বা মিশ্রিতকরণ) করে প্রকৃত নামের ওপর মো. বেলাল হোসাইন, পিতা মো. নাজিম উদ্দিন নাম বসিয়ে সে সময় রাণীনগর উপজেলার ৫ নং বড়াগাছা ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) নিয়োগ লাভ করে। তখন থেকেই একাধিক সুবিধাভোগী মহলের ছত্র-ছায়ায় নিজের খেয়াল-খুশি মতো নিয়ম বহির্ভুত ও অবৈধ ভাবে নিকাহ রেজিস্ট্রারের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
অপরদিকে, অন্যের সার্টিফিকেট টেম্পারিং করে নিজের ও পিতার নাম বসিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স নেওয়ার ঘটনায় রাণীনগর থানায় একটি মামলাও হয়। রাণীনগর থানার তৎকালীন ওসি সৈয়দ মোহসিনুল হক স্বাক্ষরিত ২০০৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নিকট বেলালের দাখিলকৃত (দাখিল ও আলিম পরীক্ষার) সনদসহ প্রতিবেদন চেয়ে পত্র দেন। পরবর্তীতে সেই মামলায় চার্জশিট প্রদান করা হয়।
আবার একই ঘটনায় আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জিয়া উদ্দিন মাহমুদ স্বাক্ষরিত (স্মারক নং-বিচার-৭/২এন-৬৯/২০০২-৫৭২, তাং ১৪-১১-২০০৭) পত্রে তৎকালীন নওগাঁ জেলা রেজিস্ট্রার মো. জহির উদ্দীনকে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেয়। সে মোতাবেক মো. বেলাল হোসাইনকে ২০০৭ সালের ২ ডিসেম্বর মূল সার্টিফিকেটসহ স্বশরীরে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে মূল সার্টিফিকেট নিয়ে হাজির না হয়ে কৌশলে একই দিন পদত্যাগপত্র দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের (কাজী) পদ থেকে অব্যাহতি নেন বেলাল হোসাইন।
কিন্তু ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় এসব ঘটনা গোপন করে পরবর্তীতে আবার নিয়োগ নিলেও উচ্চ আদালতের আদেশে সেই নিয়োগ স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু সে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কাজী বেলাল হোসাইন অবৈধ ভাবে করে আসছে পুরো নওগাঁ জেলাজুড়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
আল-আমিন দাখিল মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক ও প্রকৃত সার্টিফিকেটধারী বেলাল উদ্দিন বলেন, বেলাল পড়াশোনায় খুবই দুর্বল ছিলো। সে দাখিল পরীক্ষায় ফেল করে। এরপর সে কোথায় পড়ালেখা করেছে তা আমার জানা নেই। পরবর্তীতে জানতে পারি যে সে কোন মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে আমার সনদপত্রগুলো সংগ্রহ করে। এই বিষয়টি আমি সেই সময়ের মাদ্রাসা সুপারসহ একাধিক ব্যক্তিকে জানালে তারা সেই বিষয়ে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তা আমার জানা নেই। কারণ ২০০৫ সালে আমি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসি। তাই পরবর্তী বিষয়গুলো আমার জানা নেই।
আল-আমিন দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার হারুনুর রশিদ বলেন, ২০০০ সালের দিকে আমি এই মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। বেলাল হোসাইন ২০০০ সালে আমার মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে। এরপর সে কোথায় লেখাপড়া করেছে তা আমার জানা নেই। তবে সে কোন এক মাধ্যম দিয়ে বেলাল উদ্দিনের সার্টিফিকেটগুলো নিয়েছিলো তা আমি লোকমুখে শুনেছিলাম।
এ বিষয়ে কাজী বেলাল হোসাইন বলেন, আমার সকল সনদপত্র সঠিক আছে। সকল সনদপত্রসহ কাগজপত্রাদি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দেওয়া আছে।
-এমএ