For English Version
শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
হোম

মিরাটি থেকে দিল্লির রাজসিংহাসনে

Published : Monday, 31 August, 2020 at 7:59 PM Count : 1135

প্রণব মুখার্জি

প্রণব মুখার্জি

বর্ণাঢ্য ৫ দশকের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে পরলোকে চলে গেলেন বাঙালী বাবু প্রণব মুখার্জি। ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রণব।  তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী।  ভারতের স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্য হন তিনি। শিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।  সেখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন পাশ করেন। 
 
কর্মজীবনের শুরুতে কলকাতায় ডাক বিভাগের কারণিক পদে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৩ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ‘দেশের ডাক’ নামে একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছিলেন তিনি। 
 
রাজনীতিতে প্রণববাবুর উত্থান ঈর্ষণীয়। ১৯৬৯ সালে মেদিনীপুর উপ-নির্বাচনে তাঁর রণনীতিতে জয়লাভ করেন নির্দল প্রার্থী। এতেই ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়েন তিনি। প্রণব বাবুকে দলে যোগদান করান ইন্দিরা। সেই বছরই রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। এরপরও ৪ বার রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন তিনি। 

সংসদীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েই ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত সৈনিকে পরিণত হন প্রণব। যার ফলে ১৯৭৩ সালে মন্ত্রিসভায় জায়গা পান তিনি। তাঁকে শিল্পোন্নয়ন (মন্ত্রক) মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। জরুরি অবস্থাতেও ইন্দিরার পাশে ছিলেন প্রণব। ১৯৮২ সালে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরলে অর্থমন্ত্রী হন প্রণববাবু। ১৯৮০ সালে রাজ্যসভায় কংগ্রেসের দলনেতা হন প্রণববাবু। 

ইন্দিরাগান্ধীর হত্যার পর রাজীবের সঙ্গে মতানৈক্যে জেরে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয় প্রণবকে। সেই সময় রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি দল গঠন করেন তিনি। তবে তা তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৯৮৯ সালে ফের কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। কংগ্রেসের সঙ্গে বিলয় ঘটান তাঁর দলের। 

১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর হত্যার পর কংগ্রেসে ফের সক্রিয় হন প্রণব। তাঁকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও। পরে তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দেন প্রণব মুখার্জি। নরসিংহ রায়ের মন্ত্রিসভায় (বিদেশমন্ত্রী) পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান এই বাঙালী। 
১৯৮৫ সালে প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হন প্রণববাবু। ২০০০ সালে তাঁকে ফের এই পদ গ্রহণ করতে হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন তিনি। যদিও কংগ্রেস নেতাদের একাংশের মতে রাজ্যের রাজনীতিতে উৎসাহ ছিল না প্রণবের। তাঁর মন পড়ে থাকতো দিল্লিতে। 

২০০৪ সালে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আসন থেকে জিতে প্রথমবার লোকসভায় যান প্রণব মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের লোকসভার নেতা নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হবেন না বলে ঘোষণা করলে প্রণব বাবুর নাম নিয়ে জোর জল্পনা শুরু হয়। যদিও শেষ মুহূর্তে মনমোহন সিংয়ের নাম ঘোষণা করেন সোনিয়া।

২০০৭ সাল একই ভাবে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রণব মুখার্জির নাম নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরে জোর আলোচনা হয়। কিন্তু তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দিতে রাজি ছিলেন না মনমোহন সিং। ফলে সেযাত্রায় রাষ্ট্রপতি হওয়া হয়নি তাঁর। 

মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলাতে হয়ে অভিজ্ঞ এই রাজনৈতিক নেতাকে। অর্থ, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মত অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের চাবি ছিল তারই হাতে। ২০১২ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর ঘোষণা করেন প্রণব। এরপর কংগ্রেসের তরফে রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই প্রথম বাঙালি হিসাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯ সালে তাঁকে ভারতরত্নে ভূষিত করে কেন্দ্রীয় সরকার। 

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও কখনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি প্রণবকে। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ সময় দিল্লিতে বাঙালির অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। সংসদীয় রাজনীতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকলেও প্রথমবার জনগণের ভোটে জিতে সংসদে যাওয়ার স্বাদ তিনি পান ২০০৪ সালে। মাত্র ২ বার জনগণের ভোটে জিতে সংসদে গিয়েছেন তিনি।

১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাঁতপাকে বাঁধা পড়েন শুভ্রা মুখার্জির সঙ্গে। শুভ্রা মুখার্জির পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইল জেলায়। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় পাড়ি জমান। শুভ্রা মুখার্জি ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ৭৪ বছর বয়সে নয়াদিল্লির এক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রণব-শুভ্রার পরিবারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। 

করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। গত ৯ আগস্ট তিনি নিজের বাড়িতে পড়ে যান। মাথায় আঘাত লাগে, অবশ হতে থাকে বাঁ হাতও। পরের দিনই তাই দিল্লির সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান, দ্রুতই অস্ত্রোপচার দরকার। অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে গিয়ে বোঝা যায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের শরীরে বাসা বেঁধেছে করোনা ভাইরাস। সেই খবর তিনি নিজেই টুইট করে জানিয়েছিলেন। ৮৪ বছর বয়সে এই জীবাণুর থাবা থেকে নিরাপদে অস্ত্রোপচার করে সুস্থ করে তোলাটা চিকিৎসকদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েই তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। তারপরই তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। গত দুদিন ধরে তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। ফুসফুসে সংক্রমণের জেরে বাড়ে জটিলতা। আর এদিন দীর্ঘ লড়াইয়ে হার মানলেন তিনি।

প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের বন্ধু। আর এই বন্ধুত্বের সূচনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস–এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ: দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামে।
বইয়ের এই অধ্যায়টি প্রণব শুরু করেছেন ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত ডমিনিয়ন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। এরপর জওহর লাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর আমলের বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতে যখন এসব ঘটছিল, তখন পাকিস্তানের পূর্বাংশে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এ ঘটনাই ১৯৭১ সালে উপমহাদেশের ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাকিস্তানের জন্য বছরের শুরুটা ইতিবাচক হলেও বছরের শেষে দেশটি ভাগ হয়ে যায়।

২০১৩ সালে ৩ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসছেন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তখন প্রণব মুখার্জি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয় ৭৫’এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার পর তিনি (শেখ হাসিনা) যখন দিল্লিতে নির্বাসিত ছিলেন। ২০০৭ সালের সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের কথা উল্লেখ করে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা আমার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু এবং আমি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে ভারত সহায়তা করেছিল।’  সে সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘প্রকৃত ঘটনা হলো, যখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা তাঁকে ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁদের ভর্ৎসনা করে বলি, যখন কেউ বিপদে পড়েন, তখন তাঁকে ত্যাগ করা অনৈতিক।’

এইচএস

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,   [ABOUT US]     [CONTACT US]   [AD RATE]   Developed & Maintenance by i2soft