স্কুল থেকে প্রশ্ন তৈরি করে খামে ভরে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর সেই প্রশ্ন দিয়েই মায়েরা তাদের সন্তানদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। করোনায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে এভাবেই বাড়িতেই মডেল টেস্ট পরীক্ষা নেয়া শুরু করেছে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী রাধানগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলীর নির্দেশনায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নেয় তারা। সোমবার থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাগ্রহণ শুরু হয়। ক্রমনয়ে প্রত্যেক শ্রেণির ছাত্রীদের এই পদ্ধতিতে মডেল টেস্ট পরীক্ষা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে তারা।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনায় সারা দেশের মতো ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে পঞ্চগড়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনায় দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম আর শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় বড় ছন্দপতন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়াশুনায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় পিছিয়ে পড়ে পঞ্চগড়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশেষ করে অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েন। এই পরিস্থিতির মধ্যে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্ন তৈরি করে আলাদা আলাদা খামে ভরে বিনামূল্যে তা প্রতিটি শিক্ষার্থীর বাড়িতে পৌছে দিচ্ছেন। প্রত্যন্ত এলাকার অভিভাবকরা সেই প্রশ্ন বাক্সে তালাবদ্ধ করে রাখছেন। প্রতিদিন পরীক্ষার সময় বাক্স খুলে খাম থেকে প্রশ্ন বের করে দেন তারা। রুটিন অনুযায়ী সেই প্রশ্নে একযোগে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত ৩ ঘন্টা পরীক্ষা নেন মায়েরা।
স্কুলের আদলেই পরীক্ষা নেয়া হলেও এখানে কক্ষ পরিদর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন মা। প্রশ্ন অনুযায়ী যে যার মতো উত্তর করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মায়ের হাতে খাতা তুলে দিচ্ছেন। কেউ ঘরে আবার কেউ বারান্দায় বসে পরীক্ষা দিচ্ছেন। স্কেল, কলম এমনটি ঘড়িও রাখা আছে সাথে। পাশেই বসে লক্ষ্য রাখছেন মায়েরা। ছাত্রীদের প্রতিটি বাড়িই এখন হয়ে উঠেছে এক একটি পরীক্ষা কেন্দ্র। বাড়িতেই পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাওয়ায় উচ্ছসিত শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী তামান্না আক্তার বলেন, বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আমরা ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। এখন স্যারেরা বাড়িতেই মডেল টেস্ট পরীক্ষা নিচ্ছেন। এতে আমাদের পিছিয়ে পড়া বিষয়গুলো নিয়মিত চর্চা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
একই শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজমা আক্তার বলেন, এরকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলাম না আমরা। এত বড় ছুটিও কোনদিন পাইনি। তাই সব এলোমেলো হয়ে গেছে। বাড়িতে মায়ের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা দেয়ার বিষয়টি আমার কাছে একটি নতুন অভিজ্ঞতা। বন্ধের মধ্যে বাড়িতেই পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাওয়ায় ভাল লাগছে।
অনুপমা রায় বলেন, আগে স্কুলে যেভাবে পরীক্ষা দিতাম এখন বাড়িতেই সেভাবে পরীক্ষা দিচ্ছি। এতে করে আমরা এসএসসি পরীক্ষার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে পারছি।
রিয়া আক্তার বলেন, ঘড়ির কাটা ধরে ঠিক ১০ টায় মা খাতা ও প্রশ্ন দিচ্ছেন এবং দুপুর ১ টা বাজলেই খাতা নিয়ে নিচ্ছেন। এর মধ্যেই আমরা কমন অনুযায়ী প্রশ্নের উত্তর লিখছি।
অভিভাবক হোসেন আলী বলেন, করোনার মধ্যে মেয়েদের লেখাপড়া হচ্ছিল না। স্কুল বন্ধ থাকায় তারা পিছিয়ে পড়েছে। বিদ্যালয়ের চাপ না থাকলে যেমনটি হয় আরকি। এখন স্যারেরা বাড়িতেই পরীক্ষা নিচ্ছেন। তারা প্রশ্নে খাম বাড়িতে পৌছে দিয়েছেন। আমরা প্রশ্নগুলো বাক্সে তালাবদ্ধ করে রাখছি। যেদিন যেই পরীক্ষা সেদিন শুধুমাত্র সেই প্রশ্ন বের করে দিচ্ছি। পরীক্ষার সময় মায়েরা গার্ড হিসেবে বসে থাকছেন।
তার মতো নাসিমা খাতুন নামে আরেক অভিভভাবক জানান, এটি অনেক ভাল উদ্যোগ। আমার মেয়ে আবারো নিয়মিত পড়ার টেবিলে বসছে। বাড়িতে পরীক্ষা নেয়ায় আলাদা একটি চাপ তৈরি হয়েছে। যেদিন পরীক্ষা সেদিন মেয়েকে আমি ১০ টার আগেই খাইয়ে দাইয়ে তৈরি করে পরীক্ষায় বসিয়ে দেই। ১০ টায় খাতা ও প্রশ্ন বের করে দেই। টানা তিন ঘন্টা আমি বসে দেখভাল করছি। আমাদের জন্যেও এটি একটি নতুন অভিজ্ঞতা।
রাধানগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলী বলেন, এটি প্রত্যন্ত এলাকার একটি স্কুল। করোনার মধ্যে দীর্ঘদিন তারা ঘরবন্দি হয়ে রয়েছে। বিদ্যালয়ে আসতে না পারায় তারা দিন দিন অলস হয়ে পড়ছে। পিছিয়ে পড়ছে পড়াশুনা থেকে। তাই আমরা বিদ্যালয়ের উদ্যোগে বাড়িতেই তাদের মডেল টেস্ট পরীক্ষা নেয়া শুরু করি। যাতে করে তারা লেখাপড়াটা নিয়মিত চর্চা করার সুযোগ পায়। আমাদের শিক্ষকরা প্রত্যেক বিষয়ের প্রশ্ন তৈরি করে দিচ্ছেন সেই প্রশ্নে মায়েরা নির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা নিয়ে আমাদের কাছে খাতা জমা দিচ্ছেন। করোনাকালে এভাবেই প্রত্যেক শ্রেণির ছাত্রীদের আমরা মডেল টেস্ট পরীক্ষা নিবো। প্রত্যন্ত এই এলাকার শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে আমরা সব সময় কাজ করে যাচ্ছি। ২০১৩ সাল থেকেই এখানে মিড ডে মিল চালু রয়েছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আকতার বলেন, রাধানগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এটি অন্যদের জন্য অনুকরণীয়।
জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, বাড়িতে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি নিশ্চয়ই ভাল উদ্যোগ। এছাড়া আমরা শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনলাইন ভিত্তিক ক্লাশ চালু করেছি। জেলার ভাল ভাল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে ক্লাশ নিচ্ছেন। শুধুমাত্র পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ এই ক্লাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনলাইনভিত্তিক এই ক্লাশ কার্যক্রম স্থানীয় ক্যাবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও প্রচার করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাশ করতে পারছে।
এসআই/এইচএস