ধর্ষণের অভিযোগে শালিসে জুতাপেটা, ঘরে ফিরেই যুবকের আত্মহত্যা
Published : Friday, 24 April, 2020 at 9:29 PM Count : 747
পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখান ইউনিয়নের সোনারবান বাঁশবাড়ি এলাকায় গ্রাম্য শালিসে শিশু ধর্ষণের অভিযোগ তুলে শরিয়তি পদ্ধতিতে খয়রুল ইসলাম (১৭) নামে এক দিনমজুর যুবককে মারধর করা হয়েছে। শালিস শেষ হলেই বাড়ি ফিরে ওই যুবক ক্ষোভ ও অপমানে গলায় দঁড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় মসজিদের সামনে এই শালিস অনুষ্ঠিত হয়। সাজানো ঘটনায় শালিসের মাধ্যেমে ওই যুবককে শরিয়তি পদ্ধতিতে মারধর করা হয়েছে দাবি করে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সদর থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। শুক্রবার দুপুরে ওই যুবকের মরদেহ ময়নাতদন্তে পাঠিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে সোনারবান বাঁশবাড়ি মসজিদের সামনে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে খায়রুল ইসলাম নামে ওই দিনমজুরকে বাড়ি থেকে ধরে এনে শালিস বসায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাসহ প্রভাবশালীরা। শালিসে ওই শিশুর মা অভিযোগ তোলেন গত ২০ এপ্রিল দুপুরে তার ৬ বছরের মেয়েকে স্থানীয় গড়ের (মাটির উচু প্রাচীর) নিচে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে খয়রুল। শালিসের শুরুতেই তাকে এক দফা মারধর করা হয়। ধর্ষণের বিষয়টি অস্বীকার করেন খয়রুল শালিসে জানায় গড়ের নিচে তিনি ও তার মামাতো ভাই আজিত বসে ছিলেন। শিশুটিও সেখানে বসে ছিলো। এ সময় ওই যুবকের বাবা আব্দুর রশিদ শালিসে উপস্থিত হলে সবাই গালিগালাজ করতে থাকে। অপমান সইতে না পেরে তিনি নিজেই তার ছেলেকে জুতাপেটা করেন। পরে তিনি শালিসে উপস্থিতি বিচারকদের বিষয়টি তদন্ত করে দেখার অনুরোধ জানান। কিন্তু তারা কোন কথা না শুনে শরিয়তি বিচারে তাকে কয়েকটি বাঁশের কঞ্চি একত্র করে মারধর শুরু করেন।
শালিস পরিচালনা করেন অমরখানা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি কদম আলী, ৩, ৫, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের স্বামী আক্কাস আলী, বাঁশবাড়ি মসজিদ কমিটির সভাপতি কিতাব আলী, সাধারণ সম্পাদক জাকের খাঁ, আবু খয়ের ও দেলোয়ার হোসেনসহ বেশ কয়েক স্থানীয় প্রভাবশালী। তবে ঘটনার সময় খয়রুলের সাথে তার মামাতো ভাই আজিত থাকলেও তার কোন বিচার করা হয়নি। বিচার শেষে বাড়ি ফেরার সময় আজিতের বিচার না হওয়া নিয়ে তার চাচাতো ভাই দেলোয়ারের সাথে তর্ক হয় খয়রুলের। এক পর্যায়ে দেলোয়ার তাকে পেছন থেকে লাথি মেরে বাড়ি গিয়ে আত্মহত্যা করতে বলেন।
এর কিছুক্ষণ বাড়ি গিয়ে পরিবারের লোকজন দেখতে পায় খয়রুল তার ঘরের সরের সাথে গলায় ওড়না পেচিয়ে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। শুক্রবার দুপুরে পুলিশ ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায়। এ ঘটনায় ওই যুবকের পরিবারের পক্ষ থেকে আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
খয়রুলের বাবা আব্দুর রশিদ বলেন, আমি বাড়ি ফিরে দেখি আমার ছেলেকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়ে শালিস বসিয়েছেন। আমি শালিসে গিয়ে তাদের কথা সইতে না পেরে নিজেই আমার ছেলেকে মারধর করি। পরে বিষয়টি তাদের তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করি কিন্তু তারা আমার কোন কথা শোনেনি। তারা আমার ছেলেকে শরিয়তি পদ্ধতিতে অনেক মারধর করে। কোন কিছু না করেও এমন অপমান সইতে না পেরে আমার ছেলে আত্মহত্যা করেছে। আমি এর বিচার চাই।
খয়রুলের প্রতিবেশি আব্দুল জলিল বলেন, আমরা শুনেছি ঘটনার দিন খয়রুল তার মামাতো ভাই আজিতের সাথে বাড়ির পাশের গড়ের নিচে বসে ছিলো। ওই শিশুটিও তার সাথে বসে ছিলো। কিছুক্ষণ পরে স্থানীয় এক মেয়ে শিশুটিকে ডেকে বাড়ি নিয়ে যায়। কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন পরে হঠাৎ খয়রুলের বিরুদ্ধে তারা ধর্ষণের অভিযোগ তুলে। তাকে নিয়ে শালিস বসায় এবং শরিয়তি পদ্ধতিতে মারধর করে। সে যদি ধর্ষণ করেই থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে তারা মামলা করুক। যদি প্রমাণিত হয় আদালত তাকে শাস্তি দিবে। কিন্তু তারা তা না করে নিজেরাই শাস্তি দিয়েছে। অথচ ঘটনায় সময় সেখানে আজিত থাকলেও তার কোন বিচার করেনি তারা।
শালিসকারী আলীগ নেতা কদম আলী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ধর্ষণের অভিযোগে শালিসে আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা তার বাবাকে বলেছি তার ছেলের বিচার যেন সে নিজেই করে। ওর বাবা জুতা দিয়ে কয়েকটা মাইর দিয়েছে। পরে আমি চলে যাই। এরপর কি হয়েছে তা আমি জানিনা। আজিতের বিষয়ে কেউ কোন অভিযোগ তুলেনি তাই তার বিচার হয়নি। ধর্ষণের ঘটনায় শালিসে যেতে শুরুতে আপত্তি জানানোর কথাও বলেন এই আলীগ নেতা।
অমরখানা ইউনিয়নের ৩, ৫, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য শাহনাজ পারভীন বিউটি বলেন, আমি ব্যস্ততায় ওই শালিসে যেতে না পারায় আমার স্বামী উপস্থিত ছিলো। ওই যুবককে অন্য কেউ মারধর করেনি। তার বাবাই তাকে মারধর করেছে। তবে দেলোয়ার তাকে আত্মহত্যা করতে বলেছিলো।
পঞ্চগড় সদর থানার ওসি আবু আক্কাস আহমদ বলেন, ওই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। মামলা হলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এইচআইএইচ/এইচএস