বাংলাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে অঘোষিত লকডাউন চলছে, যা আগামী ২৫ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
আকাশ, নৌ, সড়ক ও রেলসহ সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। জরুরি জিনিসপত্রের প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সকল প্রকার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কল কারখানাও বন্ধ রয়েছে।
শুরুতে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন করা হলেও পরবর্তীতে তা কয়েক দফায় বাড়ানো হয়। এই অঘোষিত লকডাউন ২৫ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা আরও বাড়ানোর সম্ভাবনাও রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ১৮৫টি দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৮২টি দেশ পুরোপুরি বা আংশিক ভাবে লকডাউন প্রয়োগ করেছে।
কিন্তু এই লকডাউনে পুরো অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ার কারণে বিশ্বের অনেক দেশ লকউন শিথিল করার কথা ভাবতে শুরু করেছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সতর্কবাণী দিয়েছে যে, অর্থনীতি এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বের অন্তত ৩ কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছে যে, করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় বিশ্বের প্রবৃদ্ধি তিন শতাংশ হারিয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লকডাউন তুলে নিতে চাইছেন। স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়াসহ কিছু দেশ বেশ কিছু কড়াকড়ি এর মধ্যেই শিথিল করেছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, 'সামনে রোজা, আমরা সবকিছু একবারে বন্ধ করে রাখতে পারবো না। আমাদের কিছু কিছু জায়গা আসতে আসতে উন্মুক্ত করতেই হবে।'
তবে লকডাউন প্রত্যাহার বা শিথিল করার আগে ছয়টি শর্ত পূরণের তাগিদ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এসব শর্তের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে?
বাংলাদেশের অনেকেই সামাজিক দূরত্বের নিয়ম কানুন মানছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে-
১. রোগ সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিনই দেশটিতে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হচ্ছে এবং নতুন নতুন এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়ছে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশে নতুন করে রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৪৩৪ জন। ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৯৭৪ জনকে পরীক্ষা করে এই রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৩৮২ জন। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১১০ জনের।
৮ কোটি জনসংখ্যার দেশ জার্মানিতে যেখানে প্রতিদিন পাঁচ লাখ মানুষের পরীক্ষা করা হয়, ১৬ কোটির বেশি মানুষের দেশ বাংলাদেশে সেখানে প্রতিদিন পরীক্ষা করা হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার মানুষকে।
ঢাকায় যেমন রোগী শনাক্ত বাড়ছে, তেমনি ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতেও রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন করে অনেক জেলাতেও রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, 'গত কয়েক দিনের চিত্রে দেখা যায়, রোগের বিস্তার তো থামছেই না, বরং বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকার কোন লক্ষণও নেই।'
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলছেন, 'এ রকম মহামারিতে আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে, সংক্রমণের বিস্তারটা বন্ধ করে দেয়া। যেমন, নারায়ণগঞ্জের মতো যেসব জেলায় সংক্রমণ হচ্ছে, সেটা পুরোপুরি লকডাউন করে দেয়া।'
'কিন্তু বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির দেশে সেটা তো পুরোপুরি করা সম্ভব হয় ন। গত দুই তিন দিনে আমরা তো লক্ষণ ভালো দেখছি না। আমরা দেখছি, অনেক মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে। আবার যে বেরিয়েছে, সে রোগের ব্যাপারে জানে। এক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা কাজ করে।'
'এখন যে ট্রেন্ড চলছে, তাতে এই সময়ে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে, কমবে না।'
২. দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিটা রোগীকে শনাক্ত, পরীক্ষা, আইসোলেশন আর চিকিৎসায় এবং সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে শনাক্ত করতে সক্ষম
বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় আটই মার্চ। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশে রোগী শনাক্ত ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, শুরু থেকেই যদি পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো হতো, তাহলে আরও অনেক বেশি রোগী শনাক্ত হতেন।
স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তথ্য গোপন করার অভিযোগ তুলে পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বলছেন, 'বাংলাদেশ পরিচালিত হয় গোয়েন্দাদের দ্বারা। তারা জানে কিভাবে তথ্য লুকাতে হয়। পরীক্ষার দায়িত্ব শুধু একটা এজেন্সিকে দেয়া হল। দুই হাজার কিট থাকা সত্ত্বেও তারা দুশো'টা ব্যবহার করতেই সময় নিয়েছে অনেক বেশি।'
পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো হয়, সেই সঙ্গে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু এখনো পর্যাপ্ত পরীক্ষা হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ।
করোনা ভাইরাসের লক্ষণ থাকার পরেও অনেক মানুষকে পরীক্ষা করানোর জন্য তদবির করা, নানা হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হওয়ার অনেক খবর প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে।
বে-নজীর আহমেদ বিবিসিকে বলছেন, 'এখনো রোগী শনাক্ত, পরীক্ষা প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত আকারে হচ্ছে। রোগীদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে শনাক্ত করা, পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা হচ্ছে না। রোগীরা নিজেরা লক্ষণ টের পাওয়ার পর নিজেরা যোগাযোগ করেন, তারপরও তাদের ঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয়না। অনেকে সশরীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে।'
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, তার পরিচিত একজন চিকিৎসক আইইডিসিআরে করোনা ভাইরাসের লক্ষণের কথা জানানোরা দুই দিন পরেও নমুনা সংগ্রহ করতে কেউ আসেনি।
তিনি বলছেন, সংক্রমণের সংখ্যা যতো বাড়বে, এই পরিস্থিতি ততো খারাপ হয়ে উঠবে।
এছাড়া সরকার তথ্য গোপন করছে, এই অভিযোগ রয়েছে অনেকদিন ধরেই।
'করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর বাড়ি লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া হচ্ছে, বাড়িওয়ালা বের করে দিচ্ছে, সামাজিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ। ফলে অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করছেন না। এর ফলে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়ছে', বলছেন বে-নজীর আহমেদ।
রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলছেন, এখন যে রোগী শনাক্ত হচ্ছেন, যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্ত ব্যক্তি যাদের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টাইন করা) খুব গুরুত্বপূর্ণ।
'তারা কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কোথায় কোথায় গেছেন, কি করেছেন, তাদের বাড়িতে কে এসেছেন, কোন দোকানে গেছেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করা, সেগুলো জানা দরকার।'
কন্ট্রাক্ট টেসিং একেবারেই হচ্ছে না বলে তিনি মনে করছেন।
৩. নার্সিংহোমের মতো সেবা কেন্দ্রগুলোর মতো নাজুক স্থানগুলোয় ঝুঁকি নিম্নতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা
রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলছেন, উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে নার্সিং হোমের প্রসার নেই। ফলে এখানে হয়তো সেটা ততোটা প্রকট হবে না।
তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যেসব হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা দেখা হচ্ছে, সেগুলো ছাড়াও অন্যান্য হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরাও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।
ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্সসহ মোট ৪২ জন করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্স এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
আক্রান্ত হওয়ার আগে অনেক সাধারণ রোগী এই চিকিৎসক ও সেবিকারা অনেক সাধারণ রোগীকে সেবা দিয়েছেন। কিন্তু কন্ট্রাক্ট টেসিং না হওয়ার কারণে সেই ব্যক্তিরাও কোন পরীক্ষা নিরীক্ষার বাইরে থেকে গেছেন।
শুধু কিশোরগঞ্জ জেলাতেই ৪১ জন স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন। সিলেটের একজন চিকিৎসক কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
বাংলাদেশ চিকিৎসক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এ পর্যন্ত ২০৫ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ১শ জনের বেশি নার্স।
বিবিসির সঙ্গে আলাপে অনেক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে নিম্নমানের গাউন, মাস্ক দেয়ার অভিযোগও উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, রোগীরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নেয়ায় আর পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম না থাকার কারণে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, 'চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা এখনো করা যায়নি। যে রোগীরা হাসপাতালে যাচ্ছেন, তাদের সেবার ব্যাপারটি ঠিকভাবে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।'
'ফলে এসব স্থানে ঝুঁকি তো থেকেই যাচ্ছে, বরং সেটা আরও বাড়ছে।'
৪. স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত ও অন্যান্য দরকারি স্থানে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের সরকার সীমিত আকারে কিছু প্রতিষ্ঠান চালুর কথা ভাবতে শুরু করেছে।
তবে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, মে মাসে রমজানের ছুটি থাকার কারণে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকবে। অফিস-আদালতের সময়সূচিও হবে সীমিত। খুলে দেয়া হতে পারে কল কারখানা, গার্মেন্ট কারখানাগুলো।
কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা বে-নজীর আহমেদ বিবিসিকে বলছেন, 'এ বিষয়ে সুরক্ষার, সংক্রমণ ঠেকাতে আসলে সরকারের এখনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না।'
'যারা কাজের জন্য ঢাকায় ফিরে আসবেন, তারা কতটা সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করবেন, তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা কী হবে? ঢাকার বাইরে যারা সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের অনেকে ফিরে এসে কাজে যাবেন, তাদের কোন পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে কি না?'
'বিশেষ করে গার্মেন্টস কারখানার মতো স্থানে একজনের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেটা ঠেকাতে কি কোন প্রস্তুতি, পরিকল্পনা আছে?'
'সে রকম কোন কিছুই কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র লকডাউন তুলে নিলেই তো হবে না। লকডাউন তুললেও যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি না হয়, সেটা তো নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সে রকম কোন কিছুই আদৌ দেখা যাচ্ছে কি?'
'প্রস্তুতি না থাকলে রোগটি ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়বে। তাতে কর্মশক্তির একটা বিপদ তৈরি হবে। সেই সঙ্গে আমরা যে ‘পিক’ পরিস্থিতি দেখার জন্য অপেক্ষা করছি, সেটা আরও দীর্ঘ হবে।'
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলছেন, 'অর্থনীতির কথা চিন্তা করে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা যেতে পারে। কিন্তু এখনো একদম সবকিছু খুলে দেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এই সময় সংক্রমণ আরও বাড়বে, কমবে না। তাই এই সময়ে সবকিছু চালু করা একটু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।'
৫. বাইরে থেকে আসা নতুন রোগীদের সামলানো
চীনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দেশটি উহানের মতো এলাকা লকডাউন করে রেখে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পেলেও, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের মাধ্যমে আবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শুধুমাত্র দেশীয় রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি বাইরে থেকে যেন নতুন করে সংক্রমণের আমদানি না হয়, সেটাও ঠেকাতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা ততোটা সুবিধাজনক নয়।
বাংলাদেশের প্রথম যারা শনাক্ত হয়েছেন, তারা সবাই বিদেশ থেকে এসেছেন অথবা বিদেশ ফেরতদের কাছাকাছি গিয়েছেন। পরবর্তীতে সংক্রমণ স্থানীয় ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
মার্চ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ থেকে বেশির ভাগ দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
স্বাস্থ্য বিভাগের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ বলছেন, 'অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে আসার একটা চাপ রয়েছে বাংলাদেশের ওপর। বিমান চলাচল শুরু হওয়ার পর অনেকেই দেশে আসতে শুরু করবেন। নতুন করে বিস্তার ঠেকাতে তাদের সবার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা থাকা দরকার। আমরা আগে যে ভুল করেছি, সেটা যেন আবার না হয়।'
তবে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ব্যাপকহারে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন চালু করার কোন ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আসেনি। আশকোনা হজ্জ ক্যাম্পে বিদেশ ফেরতদের থাকার কথা বলা হলেও, সেখানকার পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।
তবে শুধু বিদেশ ফেরত নয়, যান চলাচল শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশংকাও করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশের সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় অফিস-আদালত খুললে সবাই নানা কাজে ঢাকা আসতে শুরু করবেন।
'তখন ঢাকার বাইরে যেমন সংক্রমণ ঢাকার ভেতরে আসতে থাকবে, আবার ঢাকায় সংক্রমিত রোগীরা দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ছড়িয়ে পড়বেন।'
বে-নজীর আহমেদ বলছেন, 'অভ্যন্তরীণ ভাবে এই ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে হলে দীর্ঘদিন জেলাগুলো বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা তো আর সম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কড়াকড়ি বা সতর্কতার কোন উদ্যোগও নেই, সেই সক্ষমতাও বাংলাদেশের নেই।'
'আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এ ধরণের ঝুঁকি সামলাতে দক্ষতার অভাব রয়েছে। ফলে লকডাউন তুলে নেয়ার পর এই ঝুঁকি থেকেই যাবে। আমার ধারণা, এখনকার ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, কলেরার মতো করোনা ভাইরাস আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি একটা সমস্যার তৈরি করবে।'
এক্ষেত্রে জনগণকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এই বিশেষজ্ঞ।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ, আইইডিসিআরের কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর অবশ্য বলছেন, 'এভাবে লকডাউন করে তো আর চিরকাল থাকা যাবে না। মানুষকে ছাড় দিতে হবে। কোথাও কোথাও কয়েক ঘণ্টার জন্য ছাড় দেয়া হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষে এটা করা খুব কঠিন। আমরা সহজে সেটা পারবোও না।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্তগুলো পূরণ করতে আমাদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে বলে মনে করছেন এই কর্মকর্তা।
'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একদম আদর্শ পরিস্থিতির কথা বলছে। অতো আদর্শিক পরিবেশে কারো পক্ষেই যাওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু কয়েকটা শর্ত, চারটা পাঁচটাও যদি আমরা মানতে পারতাম, তাহলে সংক্রমণ অনেক কমে যেত।'
৬. সমাজের বাসিন্দারা পুরোপুরি সচেতন, সতর্ক ও নতুন জীবনযাপনের ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে একমত, করোনা ভাইরাসের সতর্কতার ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে।
সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য ও মানুষজন যেন ঘরে থাকে তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি সারাদেশে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে।
তারপরেও অসতর্ক চলাফেরা ও সামাজিক দূরত্ব না মানার অনেক ছবি ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ বলছেন, 'দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রথম থেকেই জনগণকে অনেক ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে। যেমন করোনা সাধারণ রোগ, সর্দি-কাশি, বাংলাদেশের কিছু হবে না, ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে। প্রথম থেকেই ঠিক ভাবে বার্তাটি যায়নি। ফলে জনগণ এখনো সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।'
'তাই এখনো দেখবেন, অনেকে মাস্ক পড়ে না, অতোটা সতর্ক নন। এই জায়গায় এখনো বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে।'
তিনি বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগের নানা ভুল বার্তায় মানুষজনও তাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
তবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলছেন, 'শুধু সরকারের একার পক্ষে তো করোনা ভাইরাস পুরো নিয়ন্ত্রণের কাজ করা সম্ভব নয়। এ জন্য জনগণের সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এখানে জনগণের মধ্যে সেই সচেতনতা কাজ করছে না।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে, 'আমি গ্রামের সমাজের কথা যদি নাও বলি, ঢাকার বাসিন্দাদের যথেষ্ট সচেতনতা নেই। মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাজার করছে। আমার মনে হয় না তাদের আমরা কোন রকম সচেতন করতে পেরেছি। এক্ষেত্রেও আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি।'
সূত্র, বিবিসি বাংলা।
-এমএ