একদিকে মৃত্যু আতঙ্ক মহামারী করোনা ভাইরাস, অন্যদিকে ঘরবন্দি হয়ে ক্ষুধার্ত থাকার ভয়। এই উভয় আতঙ্ক ও খাদ্য সংকটের শঙ্কায় বিপাকে পড়েছেন দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার নিম্ন আয়ের মানুষ।
যাদের দিন খেটে দিন এনে চলে টানা সংসার। দু’চোখে তাদের এখন দুঃশ্চিন্তার পাহাড়। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রকোপে মৃত্যুর আতংকের সঙ্গে অর্থ সংকটের তীব্র প্রভাব তৈরি হয়েছে। এই মরণঘাতী ভাইরাস থেকে সুরক্ষা পেতে সর্বস্তরের জনগণকে ঘরে থাকার নির্দেশনাসহ গণজমায়েত বন্ধ করতে অঘোষিত লোকডাউন চলছে। এ কারণে নিম্ন আয়ের মানুষদের আয়-রোজগারহীনতায় চলছে চরম দূর্ভোগে জীবন।
এদিকে, করোনা আতঙ্ক এখন ঘরে ঘরে। সামান্য অসুখ বিসুখ হলেও ভয়ে যাচ্ছেন না হাসপাতালে। বিদেশ ও ঢাকা থেকে কেউ এলাকায় ফিরলেও দেখা দিচ্ছেন না। স্থানীয় প্রশাসন তাদের হন্যে হয়ে খুঁজলেও যেন হাওয়ায় মিশে থাকছেন তারা। কাউকে বিদেশ কিংবা ঢাকা থেকে এলাকায় আসতে শুনলে ঘিরে ধরছে আতঙ্ক। ভয়ে বিদেশ ও ঢাকা ফেরত প্রতিবেশির আশপাশে যাচ্ছে না কেউ।
হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তির পরিবারের লোকজনদেরও সংক্রমিত হওয়ার আতঙ্ক ভর করছে। এছাড়া তিন দিক সীমান্তঘেষা এলাকা হওয়ায় সীমান্তপথে কালোবাজারি যাতায়াতে রয়েছে করোনা আতঙ্ক। যার কারণে ক্রমেই বাড়ছে আতঙ্ক।
জেলা সিভিল সার্জন ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এখনো জেলায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কারও সন্ধান পাওয়া যায়নি। আইসোলেশনে নিয়ে একজনকে পরীক্ষা করে পাওয়া যায়নি করোনা ভাইরাস। ১৬ মার্চ থেকে হোম কোয়ারেন্টাইন শুরু হয় পঞ্চগড়ে। ৬৮৯ জনের মধ্যে এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে আছে ৩৬৮ জন। ভাইরাসটি প্রতিরোধে চলছে অঘোষিত লকডাউন। শহর ছাড়াও গ্রামে গ্রামে মানুষ এখন ঘরবন্দি।
অঘোষিত লকডাউনে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গণজমায়েত হয় এ রকম সকল কর্মস্থল, হাটবাজারের দোকানপাট, গণপরিবহন ও সাধারণ পরিবহনও। এতে করে চরম সংকটে পড়েছে শ্রমজীবি ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এ অঞ্চলে পাথর শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ । এদের মধ্যে সীমান্ত প্রবাহিত মহানন্দা নদীতে পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন ১০ হাজারেও বেশি শ্রমিক।
করোনা ঝুঁকিতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নদীতে পাথর উত্তোলনও। অবৈধ ভাবে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই চলছে পাথর শ্রমিকদের কর্মহীন দূর্ভোগ। বিপাকে পড়েছেন পাথর ব্যবসায়ীরাও।
মহানন্দা নদী পাড়ের ইলিয়াস উদ্দিন, হারুন, রাইজুল ও বাবুল হোসেন পাথর ব্যবসায়ী। তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, নদীতে পাথর তোলা বন্ধ। দেশের বাইরে থেকে বিশেষ করে ভারত ও ভুটান থেকে পাথরও আসছে না। আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখন পথে বসে যাওয়ার উপক্রম। চরম বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র চাষীরাও। চা পাতার উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় খরচের দামও উঠছে না। নেই বেচাকেনা। কাজে ডাকছেন না শ্রমিকদের। কাজ বন্ধ ও করোনা আতঙ্কে ঘরবন্দি হয়ে থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছে চা শ্রমিকরাও।
রোজগার নেই সামান্য ভ্যান ও অটোরিকশা চালকদেরও। আঞ্চলিক পরিবহন বন্ধ রাখার ঘোষণায় চালাতে পারছেন না এসব ক্ষুদ্র যানবাহন। প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না বিধায় দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই ভ্যানচালকদের। তার মধ্যে করোনা ভাইরাসের কারণে ঘরবন্দি থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে চলছে অর্ধাহারে জীবনযাপন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ভ্যান চালক মিনহাজ, রাজ্জাক, আবুল হোসেন, জমিরুল ইসলাম জানান, একদিন ভ্যান নিয়ে বের না হলে খাবার জোটে না। সকাল থেকে শহরে ঘুরে বিকেল পর্যন্ত ১০০ টাকাও কামাই হয়নি। শহরের রাস্তায় লোকজন নাই, তাই যাত্রীও নাই। আয়-রোজগার করতে না পারলে পরিবারের খাবার জুটবে কেমনে বুঝতেছি না।
কালান্দিগঞ্জ ও শারিয়ালজোত এলাকার ইজিবাইকচালক হোসেন আলী ও নুরুল হক বলেন, আমরা গরীব মানুষ। প্রতিদিন অটো চালিয়ে চাল, ডাল কিনে খাই। গাড়ি চালানো নিষেধ থাকলেও উপায় নাই। অটো নিয়ে এসেছি কিন্তু কোন যাত্রী নাই। সব ফাঁকা। এ অবস্থা চলতে থাকলে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে অনাহারে থাকতে হবে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কাজ বন্ধ থাকা দিনমজুর, দরিদ্র মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিলেও এখনো গ্রামের মানুষের কাছে খাবার পৌঁছেনি বলে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের। তবে সীমান্তবর্তী এসব গ্রামগুলোর নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে প্রশাসন।
দর্জিপাড়ার পাথর শ্রমিক জয়গুন ও কদবানু জানান, পাথর সাইটে কাজ করে সংসার চলে। মহাজন কাজ বন্ধ করে দিছে। আর করোনা ভাইরাসে ভয়ও লাগে, তয় বাড়িত তো থাকমু-খামু কি। খুব কষ্টে আছি ভাই, খুব কষ্টে। এ রকম কষ্ট এখানকার শত শত নারী পাথর শ্রমিকের। যারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধূলোবালিতে কাজ করে মহাজনের কাছ থেকে দিন হাজিরার কায়িক শ্রমে চলছিল সংসার।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মাসুদুল হক জানান, সবচেয়ে বেশি বেকার হয়ে পড়েছেন এই উপজেলার মানুষ। কারণ এই এলাকায় অধিকাংশ মানুষ চা, পাথর শিল্প সংশ্লিষ্ট এবং বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরের নানা কাজে জড়িত। করোনা ভাইরাসের উপদ্রবের কারণে তারা এখন সম্পূর্ণ বেকার। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ত্রাণ পাওয়া গেছে তা অপ্রতুল। আমরা ইতিমধ্যে তালিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছি। সরকারের পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের খাদ্য সহযোগিতায় তিনি স্থানীয় ও দেশের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। আর এখানকার হাটবাজারে, পথে প্রান্তরে অবস্থানরত মানসিক ভারসাম্যহীনদের খুঁজে খুঁজে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে'
-এসকেডি/এমএ