ইতালি থেকে বাংলাদেশেরত দুই জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসময় তাদের পরিবারের একজনেরও শরীরেরও করোনার উপসর্গ টের পেয়ে আক্রান্তরা নিজেরাই আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করে নিজেদের ব্যাপারে তথ্য দেন বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআর মহাপরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা।
রোববার (৮ মার্চ) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সম্মেলন কক্ষে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তিনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো বিমানবন্দরের থার্মাল স্ক্যানারে করোনা উপসর্গ ধরা পড়েনি। আক্রান্তরা নিজেরাই আইইডিসিআর হটলাইনে নিজেদের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে জানান।
মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, তারা বাসায় এসে নিজেদের মাঝে রোগের উপসর্গ টের পেয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তাদের রক্তের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হই যে তারা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।
আইইডিসিআর পরিচালক জানান, করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে একজন নারী, দু’জন পুরুষ। তবে তিনি তাদের পরিচয় প্রকাশ না করেই জানিয়েছেন, ইতালি থেকে দু’জন ঢাকায় আসার পর ঢাকার বাইরে যাননি। তাদের সংস্পর্শে আসা তৃতীয় ব্যক্তিও ঢাকার। ইতালি থেকে যে দু’জন এসেছেন, তারা দু’জন ভিন্ন পরিবারের। এর মধ্যে একজনের সংস্পর্শ থেকে তার পরিবারের অপর আরেকজন ব্যক্তির মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। আক্রান্তদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া তিন জনের বাইরে আরো তিন জনকে কোয়ারেনটাইন করে রাখা হয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আক্রান্ত ও কোয়ারেনটাইনে রাখা ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হয়েছে। ইতালি থেকে দুই ব্যক্তি দেশে আসার সময় তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ ছিল না। পরে জ্বর ও সর্দি-কাশি দেখা দিলে তারা আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দ্রুত তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গতকাল ৭ মার্চ আমরা আক্রান্ত ব্যক্তিদের কন্টাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা) করেছি। তাদের রক্তের নমুনাও পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে আরো একজনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে।
যারা দেশের বাইরে থেকে এসেছেন বা আসছেন, তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের যেকোনো ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয় ব্রিফিং থেকে। একইসঙ্গে দেশের বাইরে যারা আছেন, তাদের প্রতিও নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
এদিকে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. ফ্লোরা এনিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলেও এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। করোনো নিয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার জন্য এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করারও আহ্বান জানান তিনি। প্রত্যেককে এখনই মাস্ক পরে ঘুরে বেড়াতে হবে, এমন পরিস্থিতি হয়নি। তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে যোগা করেন আইডিসিআরের এই পরিচালক।
ডা. ফ্লোরা বলেন, এই ভাইরাস যেন অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে, আমরা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারব বলে আশাবাদী। এ বিষয়ে আমরা গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করছি। আমরা মনে করছি না, এই ভাইরাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সরকারের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, আমরা হাসপাতালগুলোতে আইসোলেটেড ইউনিটের ব্যবস্থা করেছি। এখন আমরা আইসোলেটেড হাসপাতাল করা যায় কিভাবে, তা দেখছি। শুধু হাসপাতাল নয়, স্কুল-কলেজ বা অন্য কোথাও-ও হাসপাতাল স্থাপন করা যায় কি না, এবিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখতে হবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. ফ্লোরা বলেন, এখনই সে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছি না। তবে জনসমাগম ও গণপরিবহন যতটাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাকি সময় ঘরে থাকাই শ্রেয়।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬ হাজার ১৯৫ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬০০ জনে। এছাড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত ৬০ হাজার ১৯০ জন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। বিশ্বব্যাপী ১০৩টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে।
শুধু চীনের মূল ভূখণ্ডেই করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ৬৯৬ এবং মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৯৭ জনের। চীনের পর করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশটিতে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ১৩৪ এবং মৃত্যু হয়েছে ৫০ জনের।
চীনের বাইরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ইতালিতে। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ৮৮৩ এবং মৃত্যু হয়েছে ২৩৩ জনের। অপরদিকে, ইরানে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৮২৩ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ১৪৫ জন।
জাপানে নোঙ্গর করা প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেসের ৬৯৬ যাত্রী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের। জার্মানিতে এই ভাইরাসে ৮শ জন আক্রান্ত হয়েছে। ফ্রান্সে ৯৪৯ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ১৬ জন। জাপানে আক্রান্ত হয়েছে ৪৬১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের।
স্পেনে আক্রান্ত ৫২৫ এবং মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের, যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ৪৩৮, মৃত্যু ১৯। সুইজারল্যান্ডে আক্রান্ত ২৬৮ এবং মারা গেছে ১ জন, যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত ২০৯ মৃত্যু ২। ইরাকে আক্রান্ত ৫৪, মৃত্যু ৪। ভারতে ৩৪ জন আক্রান্ত হয়েছে। তবে দেশটিতে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগীর প্রাণহানি ঘটেনি।
এছাড়া, সুইডেন আক্রান্ত ১৬১, সিঙ্গাপুরে ১৩৮, নেদারল্যান্ডসে আক্রান্ত ১২৮ এবং মৃত্যু ১, নরওয়েতে আক্রান্ত ১২৭, বেলজিয়ামে ১০৯, হংকংয়ে ১০৮, মালয়েশিয়ায় ৯৩, অস্ট্রিয়ায় ৮১, অস্ট্রেলিয়ায় আক্রান্ত ৭৭, মৃত্যু ৩, বাহরাইনে ৮৫, কুয়েতে ৬১, কানাডায় ৬০, থাইল্যান্ডে ৫০ এবং মৃত্যু ১, তাইওয়ানে আক্রান্ত ৪৫ এবং মৃত্যু ১, গ্রিসে ৬৬, আমিরাতে ৪৫, আইসল্যান্ডে ৫০, সান মারিনোতে ২৬ জন আক্রান্ত এবং মৃত্যু ১, ডেনমার্কে আক্রান্ত ২৭, লেবাননে ২৮, ইসরাইলে ২৫, চেক রিপাবলিকে ২৬, আয়ারল্যান্ডে ১৯, আলজেরিয়াতে ১৯, মিসরে ৪৮ এবং ভিয়েতনামে ১৭ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
অপরদিকে, ওমানে ১৬, ফিলিস্তিনে ১৯, মিসরে ১৫, ফিনল্যান্ডে ১৯, ব্রাজিলে ১৯, ইকুয়েডরে ১৪, পর্তুগালে ১৩, রাশিয়াতে ১৫, ক্রোয়েশিয়ায় ১২, কাতারে ১২, ম্যাকাউতে ১০, এস্তোনিয়ায় ১০, জর্জিয়ায় ১৩, রোমানিয়ায় ১৩, আর্জেন্টিনায় ৯, স্লোভেনিয়ায় ১২, আজারবাইজানে ৯, বেলারুশে ৬, মেক্সিকোতে ৭, পাকিস্তানে ৬, ফিলিপাইনে আক্রান্ত ৬ এবং মৃত্যু ১, সৌদি আরবে ৭, চিলিতে ৭, পোল্যান্ডে ৬, স্লোভাকিয়ায় ৩, পেরু ৬, ইন্দোনেশিয়ায় ৪, নিউজিল্যান্ডে ৫, সেনেগালে ৪ ও হাঙ্গেরিতে ৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
এছাড়া লুক্সেমবার্গে ৩, উত্তর মেসিডোনিয়ায় ৩, বসনিয়ায় ৩, ডোমিনিক প্রজাতন্ত্রে ২, মরক্কোতে ২, আফগানিস্তান ৪, কম্বোডিয়া ২, বুলগেরিয়া ২, ক্যামেরুন ২, মালদ্বীপ ২, দক্ষিণ আফ্রিকা ২ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। অপরদিকে, আন্দোরা, আর্মেনিয়া, জর্ডান, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, মোনাকো, নেপাল, নাইজেরিয়া, শ্রীলঙ্কা, তিউনিসিয়া, ইউক্রেন, ভুটান, কোস্টারিকা, ভ্যাটিকান সিটি, গিব্রালটার, সার্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং টোগোতে একজন করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
এইচএস