ঋতুরাজ বসন্তের দোলাচলে বাতাসে দুলছে সবুজ চায়ের নতুন কুঁড়ি। আশা জাগছে। এ বছর স্বপ্নজাগা নতুন কুঁড়ি সবুজ চা পাতা অর্থনীতির সজীবতা এনে দেবে।
গেল বছর চা পাতার দাম না থাকায় ঘরে আসেনি সে রকম অর্থকড়ি। অকশন মার্কেটে চা পাতার মূল্য হ্রাস আর কারখানা মালিক ও কতিপয় অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজসে সিন্ডিকেটের কারণে ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছে ক্ষুদ্র চা চাষীদের।
বাগানের উত্তোলিত চা পাতা ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে না পারায় ঘর থেকে দিতে হয়েছে শ্রমিকের মজুরী ও সার-কীটনাশকের দাম। যে কারণে ২০১৯ সালটি চরম হতাশার মধ্যে গেছে দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার চা চাষীদের।
সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরই চা শিল্পের জন্য তৃতীয় অঞ্চল খ্যাত এখন উত্তরের পঞ্চগড়। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি এখন চায়ের সবুজ পাতায় ভরে উঠছে। আন্তর্জাতিক মানের চা উৎপাদন হওয়ায় দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখানকার চা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে।
চা-বাগানের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। সৃষ্টি হয়েছে মানুষের কর্মসংস্থান। সারা বছরই চলে চা বাগানের কাজ। বাগানে কাজ করেন পুরুষ ও নারীরা। গত বছর বাজারে চা পাতার দাম না থাকায় শ্রমিকরা পাননি তেমন কাজ।
এ বছরে অধিক চা উৎপাদন ও চা পাতার ন্যায্য মূল্য পেতে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ততায় সময় কাটছে চা চাষীদের। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে বাগানের পরিচর্যা। এ সময় চা কারখানা বন্ধ থাকে। এ সময়ের মধ্যে চা গাছগুলোর মাথা প্রুনিং করা হয়। প্রুনিং করার পর গাছের গোড়ার মধ্যে পোকামাকর বাসা বাধে। এসব পোকার মধ্যে উলু পোকা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই পোকা চা গাছের গোড়া বা শরীরের অংশ খেয়ে ফেলে। এসব কীট মারতে স্প্রে করা হয় কীটনাশক।
প্রুনিংয়ের কাজ শেষে চলে আগাছা ও আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ। পানি নিস্কাশন। প্রুনিংয়ের পর বৃষ্টিপাত চা বাগানের জন্য অনেকটা আশীর্বাদ। বৃষ্টির পরশ পেলেই সেই কাটা অংশ থেকে নতুন চারা গজাতে শুরু করে বলে জানালেন কাজী অ্যান্ড কাজী চা এস্টেটের দর্জিপাড়া ডিভিশন ইনচার্জ কবীর আকন্দ।
মার্চ থেকে নভেম্বর চায়ের উৎপাদন মৌসুম। চলতি বছরের শুরুতে বৃষ্টিপাতের জল পেয়ে চা বাগানের জন্য ফলপ্রদ হওয়ায় তরতর করে বেড়েছে চায়ের সবুজ কুঁড়ি। বাগানে বাগানে উঁকি দেয়া নতুন কুঁড়িতে আশা জাগছে চাষীদের চোখে-মুখে।
চা বাগানে কাজ করতে দেখা যায় দর্জিপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র চা চাষী আব্দুল করিমকে। তিনি জানান, এ বছর চা পাতার দাম পেলে তো ভালো হয়। তিন মাস ধরে বাগান পরিচর্যার কাজ করছি। আগামী মার্চে রাউন্ড পাতা দিতে পারবো।
গত বছর খুব লোকসান গুনেছি বলে জানালেন কানকাটা গ্রামের আরেক চা চাষী। কানকাটা গ্রামের আনোয়ার, শাহজাহানসহ কয়েকজন ক্ষুদ্র চাষী জানান, গত বছর খুব লোকসান গুনেছি। তবুও নতুন আশায় বাগান পরিচর্যা করে নতুন পাতা উৎপাদনে লাগাতার পরিশ্রম করছি। পাতার দাম পেলে কিছু আয় করতে পারবো।
এছাড়াও শারিয়ালজোত, মাগুরা, সাহেবজোত, আজিজনগর ও ডাঙ্গাপাড়া গ্রামগুলো ঘুরে দেখা যায়, বাগান পরিচর্যা শেষে নতুন কুঁড়িতে স্বপ্ন উকি দিচ্ছে। চা একটি দীর্ঘ অর্থকরী ফসল হওয়ায় চা চাষে দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছে দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া।
নতুন বছর উৎপাদিত কাঁচা চা পাতার পরিবহন বাদে প্রতি কেজির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ টাকা। বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ‘কাঁচা চা পাতা মূল্য নির্ধারণ’ বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরু হয়। জেলায় বর্তমানে ৭ হাজার ৫৯৮ একর জমিতে চায়ের আবাদ হয়েছে। প্রতি বছর চা চাষ বাড়ছে। এর মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলায় ১ হাজার ২শ ৯০ হেক্টর বেশি জমিতে গড়ে উঠেছে চা বাগান। এ পর্যন্ত নিবন্ধিত বড় চা-বাগান ৮টি ও অনিবন্ধিত বড় চা-বাগান ১৮টি। ছোট চা-বাগান ৮৯১টি, অনিবন্ধিত ৫ হাজার ১৮শ চা বাগান রয়েছে। চা প্রক্রিয়াজাতের জন্য কারখানা চালু রয়েছে ১৮টি।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, সমতল ভূমিতে চা চাষের জন্য পঞ্চগড় ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এলাকা। দিন দিন উত্তরাঞ্চলে চা চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চা চাষ সম্প্রসারণের জন্য চাষিদের বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। চাষিদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চাষিদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান দিতে ইতিমধ্যে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপস চালু করা হয়েছে। এ আঞ্চলিক কার্যালয়ে একটি টি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে চা চাষিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, চাষের নানান রোগবালাই ও পোকা দমনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেওয়া হয়।
-এমএ