For English Version
বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
হোম

কৃষক পরিবারে ৮ গ্রাজুয়েট

Published : Monday, 24 February, 2020 at 3:52 PM Count : 978

এ যেন এক অবিশ্বাস্য যুদ্ধ জয়ের গল্প। হারভাঙ্গা খাটুনি খেটে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন তিন ছেলে ও এক মেয়েকে। দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম আর পরিশ্রম। সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে শুধু বাড়ি ভিটে বাদে বিক্রি করে দিয়েছিলেন সব জমিজমা। লক্ষ্য একটাই সন্তানের লেখাপড়া। এতে করে বাবার উৎসাহের সংস্পর্শে সন্তানরা পূর্বে মেধাবী না থাকলেও ধীরে ধীরে হয়ে উঠে মেধা দক্ষতায় পারদর্শী।

বাবা-মায়ের দিন-রাত শ্রম দেখে লড়াই করেছে স্বপ্নজয়ের। সকল বাধাকে অতিক্রম করে চার সন্তানই আজ সাফল্যের স্বপ্নচূড়ায়। স্বপ্নপূরণ হয়েছে বাবা-মায়ের। বলছিলাম দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়ার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের সফল বাবা-মা আমজাদ হোসেন ও আমেনা বেগমের কথা। 

আমজাদ হোসেন পেশায় সামান্য একজন কৃষক। স্ত্রী আমেনা খাতুন গৃহিনী। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া সীমাবদ্ধ থাকলেও চার সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আসামের নওগাঁয় জন্মগ্রহণ করেন আমজাদ হোসেন। বাবা মোহাম্মদ আলী। দেশ ভাগের পর চলে আসেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। সেখানে আরকে হাইস্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ না করেই বাবার সঙ্গে চলে আসেন সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। এখান থেকে আনুমানিক ২৬ বছর বয়সে অংশ নেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধে অংশগ্রহণপূর্বক প্রশিক্ষণ নেন ভারতে। দীর্ঘ নয় মাসে দেশ স্বাধীন হলে কঠিন দারিদ্রতায় চলে সংসার। তবুও হাল ছাড়েননি।

সামান্য কৃষক হয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে চার সন্তানকে করেছেন উচ্চ শিক্ষিত। শুধু উচ্চ শিক্ষিত নয়, উচ্চতর শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনে সবধরনের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি। শুধু সরকারি চাকরির জন্য পড়ালেখা করাতে হবে এমনটি ভাবেননি কখনো। চেয়েছিলেন সন্তানরা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে। নিজের দক্ষতায় কর্মস্থলে সম্মানী পদ অলঙ্কিত করবে। যে শিক্ষায় থাকবে আদর্শ, সততা আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রকৃত মনুষত্ব ও উদার মানবিকতা। যা চেয়েছিলেন, তাই হয়েছে। সন্তানদের কাছেও তিনি একজন সফল বাবা হিসেবে প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছেন। শুধু তাই নয়, তিন ছেলের স্ত্রীও পেয়েছেন উচ্চ শিক্ষিত। এমনকি মেয়ের জামাতাও সম্প্রতি জাপান থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনের বাসায় গিয়ে কথা হয় সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে তোলার বিষয়ে। গল্পে গল্পে জানা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার নানান বিষয়। যুদ্ধে যাওয়ার সময় বয়স ছিল আনুমানিক ২৬ বছর। বিয়ের পরেই যুদ্ধে অংশ নিতে চলে যান ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে। প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। নয় মাস যুদ্ধের পর ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। যুদ্ধের ৩ বছর পর জন্ম নেয় বড় ছেলে মাসুদ আলম (রানা), তারপর আলী আজম রাসেল, মেয়ে রীনা পারভীন ও কনিষ্ঠ মামুন-উর-রশিদ। 

চার ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা ও বর্তমান কর্মসংস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, বড় ছেলে মাসুদ আলম রানা। থাকে লন্ডনে। একটি সংস্থার ফিনান্স এবং ক্রেডিট কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে পার্টনারশীপে গড়ে তুলেছে একাউন্টিং ফার্ম। সে একাউন্টিং ফার্মের প্রধান পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সম্প্রতি লন্ডনের ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস ইউকে (সিআইএমএ) এর অধীনে চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট সম্পন্ন করেছেন। বাংলাদেশের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ইনস্টিটিউটের অধীনে একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টির কোর্সে ভর্তি হন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.কম (ম্যানেজমেন্ট) পাস করেন। চার্টার্ড একাউন্টেন্সি কোর্স শেষ করে দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স সংস্থা লিমিটেডে ডেপুটি ম্যানেজার (অ্যাকাউন্ট)-এ দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ার্থ গ্রুপে স্যুইচ করে সেখানে ফিনান্স এবং ক্রেডিট কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করেন। ২০০৬ সালে দক্ষতা অর্জন করে মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের আওতায় যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন। ২০০৭ সালে চলে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানেই সে স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে রয়েছে। তাঁর স্ত্রী হামিদা আক্তার প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে।

মেজো ছেলে আলী আজম রাসেল। কাজ করে আমেরিকায়। সে লস অ্যাঞ্জেলেসে সিএফও হিসেবে কেয়ার ডেন্টিস্ট্রি গ্রুপে কাজ করছেন। রাসেল ২০০৭ সালে ব্যবসায় প্রশাসনের অ্যাংলিয়া রুসকিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা শেষ করতে লন্ডনে যায়। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সমাপ্ত করে। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিভ্রি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর লাভ করে। সেখানে ভেটেরান্স ফার্স্ট ওসি হিসেবে ফিনান্সিয়াল কন্ট্রোলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। সে এখন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়ায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তার স্ত্রী তমা ফারজানাও ক্যালিফোর্নিয়ার অর্গোসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টের ওপর গ্রাজুয়েশন করেছে। 

মেয়ে রিনা পারভীন। ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর অর্জন করেছে। তার স্বামী ডা. মো. মোশারফ হোসেন রাজধানী ঢাকার শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। সম্প্রতি তিনি জাপান থেকে পিএইচডি শেষ করেছেন। খুব শীঘ্রই তিনি অধ্যাপক হবেন। 

সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র মামুন-উর-রশিদ মামুন। ২০০৫ সালে তেঁতুলিয়া পাইলট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে। ২০০৭ সালে বিএন কলেজ ঢাকা থেকে এইচএসসি পাশ করে। সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১ম শ্রেণীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে। একই বছর ফলাফল প্রকাশের আগেই বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিতে গবেষণা কর্মকতা হিসেবে যোগদান করে। ২০১৭-২০১৮ সালে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলো। বর্তমানে সে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ- ঢাকায় প্রযুক্তি সমন্বয়কারী-পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে কাজ করছে। চাকুরির পাশাপাশি ব্যবসা ও সমাজ সেবা কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত। ঢাকার মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে তার "টুং টাং" নামে দুটো কফি শপ আছে। তার স্ত্রী তানিয়া হক তিন্নি ২০১৬ সালে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে এম ফার্ম ডিগ্রি অর্জন করে। বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিলের রেজিস্টার্ড গ্রেড ফার্মাসিস্ট। বর্তমানে সে ফার্মাসিউটিক্যালস ক্যামিক্যালস কোম্পানী ‘দ্য গ্লোবাল প্রসেসিং সলিউশনস লিমিটেড’-এর জি সিনিয়র এক্সিকিউটিভ-পিএমডি হিসবে দায়িত্ব পালন করছে। 

বড় ও মেজো দুই ছেলে লন্ডন ও আমেরিকায় থাকার সুবাদে ঘুরে এসেছেন সফল বাবা-মা আমজাদ হোসেন দম্পতি। এবার তারা স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের স্বপ্ন দেখছেন। এ জন্য ভিসা টিকিটের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে গ্রিন কার্ডের উদ্দেশ্যে শীঘ্রই পারি দেবেন আমেরিকায়।

সফল বাবার জ্যৈষ্ঠ ছেলে মাসুদ আলম বলেন, বাবা-মা আমাদের গর্ব। সকল সাফল্যের প্রেরণা। আজ বাবা-মায়ের জন্য আমরা শিক্ষা-দীক্ষায়, কর্মে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি। আমরা গর্বিত যে, বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান। 

সন্তানদের বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা আমজাদ হোসেন বলেন, আমাদের আর চাওয়ার কিছু নেই। গর্বে বুক ভরে যায় যে, ছেলে-মেয়েদের উচ্চতর ডিগ্রিতে পড়াতে পেরেছি। তিন ছেলের স্ত্রীও উচ্চতর ডিগ্রীপ্রাপ্ত। সামান্য কৃষকের ঘরে ৮ জন গ্রাজুয়েট। এর থেকে আর কি চাওয়ার থাকে। এ জন্য তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন।

মা আমেনা খাতুন বলেন, সন্তানদের এ স্থানে নিয়ে আসতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত পেরেছি, এটাই ভালো লাগছে।

-এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,   [ABOUT US]     [CONTACT US]   [AD RATE]   Developed & Maintenance by i2soft