সাধারণত হাট-বাজারে বাজার সদাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্ত আমাদের দেশে এমনও কিছু জায়গা আছে যেখানে জিনিষপত্রের মতই মানুষও বিক্রি হয়। আর সেখানে তারা নিজেদের মূল্য নিজেরাই নির্ধারণ করে থাকেন।
কি অবাক হলেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে বরগুনার তালতলী উপজেলা ভূমি অফিসের সামনের মাঠে চলে আসছে মানুষ বিক্রির এ হাট।
বছরের শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে এবং অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে দুই মৌসুমে বসে এ শ্রম বাজার। শ্রম বাজারটি প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে শুরু করে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এখানে মানুষ নিজেই নিজের শ্রমের মূল্য হাঁকেন।
প্রতিদিন সকালে থেকে ভীড় করেন কাস্তে ও ব্যাগ হাতে এই শ্রম বিক্রয় করা এই মানুষরা। যারা বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার প্রান্তিক অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধান এখানে আসেন। এখন আমন ফসল কাটার উপযুক্ত সময়। এ সময় শ্রমজীবী মানুষের চাহিদা থাকে বেশি। তাই এখানে বসেছে শ্রম বিক্রির হাট। রোববার সাপ্তাহিক বাজার হওয়ায় শ্রম বিক্রির হাট থাকে বেশি জমজমাট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সহস্রাধিক শ্রমজীবী মানুষ হাটে আসেন শ্রম বিক্রি করতে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ কৃষি কাজের জন্য তাদের কিনে নিতে আসেন।
শ্রম বিক্রি করা মানুষদের সঙ্গে চলতে থাকে অন্যান্য পণ্যের মতো দর কষাকষি। সকালের দিকে চাহিদা বেশি থাকে। শ্রমজীবীরা দামও বেশি পান। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে চাহিদা এবং দামও কমে যায়। তবে কোন শ্রমজীবী মানুষই অবিক্রীত থাকেন না। স্থানীয়ভাবে শ্রম জীবীদের বলে বদলা বা দিনমজুর। ৭৫ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের শ্রমজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে দলে দলে ছুটে আসেন এই হাটে। এই মানুষগুলোর অধিকাংশই আশ্রয়হীন, হতদরিদ্র। ক্রেতাদের কাছে তারা কেউ কেউ এক সপ্তাহ, আবার কেউ কেউ ১৫ দিনের ফসল কাটার জন্য বিক্রি হন।
কয়েকজন শ্রমজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দৈনিক ৪৫০ থেকে ৬শ টাকায় তারা শ্রম বিক্রি করেন। তবে শ্রম কেনা মালিকের পছন্দের ওপর নির্ভর করে মূল্য। বৃদ্ধের চেয়ে জোয়ানদের চাহিদা বেশি। অনেকে শ্রমজীবীর শারীরিক গঠন দেখেও শ্রম ক্রয় করে থাকেন।
তালতলীর শ্রম বিক্রির হাট শ্রমজীবীদের অতি পরিচিত হওয়ায় বরগুনার ছোট গৌরিচন্না, ফুলঝুড়ি, শর্শিমুড়ি, আয়লা, চান্দখালী, বেতাগী, বকুলতলী, উত্তর বকুলতলী, ঝালকাঠির আমুয়া ও নলসিটিসহ বিভিন্ন জেলার শ্রমজীবীরা এখানে আসেন। এই মানুষগুলোর অনেকে আবার স্বভাবে রসিক ও বয়াতি প্রকৃতির। সারা দিন কাজ শেষে মহাজনের বাড়িতে স্বাচ্ছন্দে বসেন কিচ্ছা (গল্প) ও গানের আসর নিয়ে। মনের সুখে গান গেয়ে কিংবা কিচ্ছা বলে অন্যকে আনন্দ দেন এবং নিজেরাও আনন্দিত হন।
আবার অনেক বয়স্ক মানুষ রয়েছেন যারা শেষ বয়সেও প্রিয় মানুষের অবহেলার শিকার মুখ খুলে কিছু বলেনা না। তেমনি একজন কাজের সন্ধানে আসা ৭৫ বছর বয়সী মালেক মিয়া। তিনি জানান, পরিবারে কোন অভাব নেই। ছেলে সন্তান নিয়ে খুব সুখে আছেন তিনি। বসে থাকতে ভালো লাগেনা, তাই এখানে কাজের সন্ধানে এসেছেন। ঠিকানা জানতে চাওয়ায় তিনি কোন কথা না বলে প্রতিবেদককে এড়িয়ে যান।
এরপর কথা হয় পোটকা খালি গ্রামের মিজান, বাবুল, সেলিম মিয়ার সঙ্গে। তারা বলেন, এ সময় গ্রামের বাড়িতে কোন কাজকর্ম নেই। তাই এ অঞ্চলে কাজের সন্ধানে ছুটে এসেছি। এলাকায় এক দিন কাজ করলে দু'দিন বসে খেতে হয়। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্ট হয়।
তারা আরও বলেন, এ অঞ্চলে কাজের চাপ বেশি হওয়ায় বদলার (শ্রমিকের) চাহিদা বেশি। দৈনিক জনপ্রতি ৫৫০ টাকা হিসেবে সাত দিনের কাজের জন্য এক মহাজনের কাছে চুক্তি হয়েছেন।
উপজেলার নিশান বাড়িয়া ইউনিয়নের রাজু মিয়া বলেন, এখন ক্ষেত থেকে ধান কাডার (কাটার) সময়। এ সময় কৃষকের কামের (কাজের) শেষ নেই। সময়ের লগে (সঙ্গে) পাল্লা দিয়ে ধান কাডা (কাটা) লাগে। তাই বদলাগো (শ্রমিকদের) চাহিদা বেশি। এ অঞ্চলে যে পরিমাণ কামের (কাজের) চাহিদা, হেই পরিমাণ কামের (কাজের) মানুষ নাই। তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বদলারা (শ্রমজীবীরা) হ্যাগো (নিজেদের) এইহানে (এখানে) বেঁচে (বিক্রি করে)।
উপজেলার লাউপাড়া গ্রামের মাহমুদুল হাসান বলেন, আমন ফসল কাটার জন্য দৈনিক জনপ্রতি ৫শ টাকায় ৭ জন বদলা ক্রয় করেছি। তাদের সঙ্গে চুক্তি 'আমার আমন ফসল সব কেটে তারপর যেতে হবে।'
-এমএইচ/এমএ