হুমকীর মুখে ভাওয়ালের শালবনগাজীপুরে বনের জমিতে শিল্পের আগ্রাসন |
![]() বনবিভাগ সূত্রে জানায়, গাজীপুরের সংরক্ষিত ভাওয়ালের জাতীয় উদ্যান বাদে গাজীপুর ও ঢাকার ২০৯টি মৌজার মোট বনভূমি রয়েছে ৫৩ হাজার ৬৭১ দশমিক ৮৯ একর। যদিও আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) রেকর্ডে রয়েছে ৪৬ হাজার ২২৩ দশমিক ২৫ একর বনভূমি। এর মধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে ১১ হাজার ৬৫৬ দশমিক ৪৭ একর বনভূমি। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বনভূমি দখলের পরিমান আরো বেশী। গাজীপুর জেলার মধ্যে রাজেন্দ্রপুর, কালিয়াকৈর, কাঁচিঘাটা, ভাওয়াল ও শ্রীপুর রেঞ্জ অফিসের মাধ্যমে বনভূমির ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষন করা হয়। এসব রেঞ্জের আওতায় বিট অফিস রয়েছে ২৭টি। গাজীপুরে ৩ শতাধিক শিল্পকারখানা ও কয়েকহাজার প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে জিআর ৫১১৮টি ও ফৌজদারি ৬৫৫টি। কয়েকদশক ধরে জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশী বনভূমি দখল হয়েছে শ্রীপুর, কালিয়াকৈর ও গাজীপুর সদর উপজেলায়। গত কয়েকবছর আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি মৌজায় আর এস ২নং খতিয়ানের ২৯২৩,২৯২৪,২৯২৫ দাগের ১৬১শতাংশ বনের জমি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দখল করে নেয় দেশের নামী দামী ক্যাবল উৎপাদনকারী বিবিএস ক্যাবল (বাংলাদেশ স্টিল বিল্ডিং মিলস লিঃ)। দখলের পর একাধিকবার বন বিভাগ অভিযান করেও কারখানার দখল থেকে কোটি টাকার মূল্যমানের এই ভূমি উদ্ধার করতে পারেনি। একই ভাবে টেপিরবাড়ি মৌজায় ডিবিএল গ্রুপ ৬ একর তেলিহাটি মৌজায় কুঞ্জু বিথি ১ একর আলিফ অটো ব্রিকস ৭০ শতাংশ আল-নূর হ্যাচারী ১ একর, টেপিরবাড়ী মৌজায় চায়না বাংলা প্যাকেজিং কারখানা-১ একর, প্রাইম ফার্মাসিউটিকেল ৭৬ শতাংশ, এইচ এস এগ্রো দেড় একর, রেক্স অটো ব্রিকস ১ একর ৭০ শাতাংশ, টেংরা মৌজায় গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেল ২ একর ৫ শতাংশ, শিশু পল্লী প্লাস সাড়ে ১২ একর, টেপিরবাড়ী মৌজায় মম পোল্ট্রি ৭০ শতাংশ, ওয়ারবিট ষ্টিল বিল্ডিং ২ একর, গিলাস্বর মৌজায় ডানা গ্রুপ ৮ একর, সাতখামাইর মৌজায় নারিশ পোল্ট্রি ২ একর ৩৩ শতাংশ, ধনুয়া এলাকার আরএ কে সিরামিকস ৪ একর, রোশওয়া স্পিনিং মিল ৪ একর, রিদিশা গার্মেন্টস ১ একর, ডিবিএল সিরামিক্স ৮ একর, অটো স্পিনিং মিলস-২ একর ২০ শতাংশ, হামিম গ্রুপের হামিম ডেনিম ৪ একর, মাওনা মৌজার মনো ফিড ২ একর ৭৫ শতাংশ, এইচ পাওয়ার লিঃ ৩৩ শতাংশ, হোম ডিজাইন ১ একর ২২ শতাংশ, সাতখামাইর মৌজার আকন্দ গার্ডেন ১৬ একর, পটকা মৌজার ট্রেড ম্যানেজম্যান্ট কর্পোরেশন ৭একর ৬৪ শতাংশ, কেওয়া মৌজার মিতা টেক্সটাইল ২ একর ২০ শতাংশ, মেঘনা কম্পোজিট ৪০ শতাংশ, জোবায়ের স্পিনিং ১ একর, ওমেগা সুয়েটার ১ একর, সোলার সিরামিকস ৯০ শতাংশ,ইকো কটন ৪ একর ৮৬ শতাংশ, ভাওয়াল ইন্ডাষ্ট্রিজ ২ একর, অনটেক লিঃ ৪ একর ৯৪ শতাংশ,হাউআর ইউ ১ একর, অরণ্যকুটির রাজ্জাকুল ২ একর ২২ শতাংশ, উইষ্টেরিয়া টেক্সটাইল ৫ একর ৩৩ শতাংশ, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল ২ একর, এপেক্স নীট কম্পেজিট ১১ একর ৬২ শতাংশ, গ্রেটওয়াল সিরামিক্স ৭ একর ৩৮ শতাংশ, এছাড়াও বনের জমি দখলে রয়েছে গ্রীন ভিউ রিসোর্ট সহ আরো অনেক নামী দামী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের দখল থেকে একাধিকবার বনের জমি উদ্ধার করার পর ফের অবৈধ ভাবে বনের গেজেটভুক্ত জমি দখল করে নিচ্ছেন তারা। ![]() গাজীপুর সদরের ভাওয়াল রেঞ্জের রাজেন্দ্রপুর পশ্চিম ভিটের নয়নপুরে বনের জমিতে গড়ে উঠেছে একাধিক বহুতল ভবন। একই ভাবে বারইপাড়া ভিটের নয়নপুর নতুনপাড়া এলাকায় চলছে বনের জমি দখলযজ্ঞ। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের আশপাশেও সংরক্ষিত বনাঞ্চল অরক্ষিত ভাবে দখল হচ্ছে। গাজীপুরের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠা বহু অবকাশ বিনোদন কেন্দ্রও অবাধে দখলে নিয়েছেন বনের জমি। এভাবে প্রতিনিয়ত আশ্রয়হীন থেকে ধনীক শ্রেণী পর্যন্ত ব্যক্তিরা সরকারী বন ধ্বংস করলেও দেখার যেন কেউ নেই। সামাজিক বনায়নের নামেও উজাড় হচ্ছে বন ঃ গাজীপুরে বন উড়াড়ের পিছনে অন্যতম দায়ী সামাজিক বনায়ন। দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য অংশীদারিত্বমূলক সামাজিক বনায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও গাজীপুরের অধিকাংশ এলাকায় সুবিধাভোগীর আওতায় আছেন ধনীক শ্রেণী ও প্রভাবশালীরাও। নামে ও বেনামে এক ব্যক্তির মাঝে একাধিক প্লট দেয়ার অভিযোগ রয়েছে বন বিভাগের বিরুদ্ধে। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে গাজীপুর ভাওয়ালের ঐতিহ্যবাহী শাল গজারীর কপিচ কেটে বনভূমি পরিস্কার করে আকাশমনি গাছের চারা রোপন করা হয়। আকাশমনি গাছের কারনে পরবর্তীতে জমি তার উর্বরতা হারিয়ে ফেলে একমসময় ধীরে ধীরে বনভূমি দখল হয়ে যায়। সীমিত জনবলও বন দখলের অন্যতম কারন ঃ বন দখলের অন্যতম কারন বনবিভাগের সীমিত জনবল। বর্তমানে গাজীপুরের বিশাল এই বনভূমি তত্বাবধানে রয়েছে বনবিভাগের ২২৫জন কর্মকর্তা কর্মচারী। বনের মামলা মোকাদ্দমা সহ নানা কাজেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতে হয় তাদের। এই ফাঁকে বন হয়ে থাকে অনেকটা অরক্ষিত। অবাধে ঢুকছে ছিন্নমূল মানুষঃ রাজধানী লাগুয়া শিল্পের রাজধানী খ্যাত গাজীপুরে কর্মসংস্থানের আশায় কয়েকবছর ধরেই অবাধে ঢুকছে ছিন্নমূল শ্রেণীর বিভিন্ন মানুষ, তারা বনপরিষ্কার করে বনের জমিতে গড়ে তুলছে ঘরবাড়ী। স্থানীয় প্রভাবশালী, বনবিভাগের দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তা কর্মচারীরাদের ম্যানেজ করে মূলত ঘরবাড়ী নির্মান করলেও পরে মানবিকতার অজুহাতে এসব বাড়ীঘর টিকে থাকে। সীমান নির্ধারন নেই বনের জমিরঃ গাজীপুরের বিভিন্ন অংশে থাকা বনের জমির দীর্ঘদিনেও সীমান নির্ধারন করা হয়নি। বনের জমির পাশে ব্যক্তিমালিকানার জমি থাকায় নানা অজুহাতে কেউ রাস্তাঘাট তৈরী করে আবার কেউবা নানা উপায়ে বনের জমি দখল করে নেন। স্থানীয়দের ভাষ্য বন বিভাগ বা স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে সংরক্ষিত বন বা বনভূমি রক্ষায় অধুনিক পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারন করা জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে। ![]() শিল্পকারখানার নিকট থেকে বন রক্ষায় সরকারী উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ ইউসুপ জানান, গাজীপুরের বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান নানা উপায়ে বনের জমি দখল করেছে। এবার আমরা এলাকাভিক্তিক দখলদারের তালিকা তৈরী করেছি. অনেকের নামে উচ্ছেদ মামলা করেছি। বনের জমি থেকে দখলদারদের উচ্ছেদে ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনের নিকট তালিকা প্রেরণ করা হয়েছে। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এমএম তরিকুল ইসলাম জানান, বন বিভাগের তালিকা অনুযায়ী ধারাবাহিক ভাবে শীগ্রই বনভূমি উদ্ধার অভিযান শুরু হবে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে কোনভাবে বনভূমি ও বন রক্ষা করতে হবে। এইচএস |