রিফাত হত্যাকাণ্ড: ১২জনকে আসামি করে মামলা, গ্রেফতার ১ |
রিফাতের মায়ের আহাজারি বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় সকালে ঘাতক নয়ন ও রিফাত ফরায়েজীসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন নিহতের বাবা। বৃহস্পতিবার সকালে নিহত রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে বরগুনা থানায় ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। এজাহারভুক্ত চন্দন নামের এক আসামিকে রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনার পরপরই বাড়ি ঘর ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে ঘাতক ও তাদের স্বজনরা। এদিকে হত্যকারীদের দ্রুত গ্রেফতার শেষে বিচারের মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার সকালে শহরের পশ্চিম কলেজ সড়কে নয়ন বন্ডের বাসায় গিয়ে বাসা তালাবদ্ধ দেখা যায়। আশাপাশের কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, বড় ভাই প্রবাসী মিরাজের বাসায় নয়ন তাঁর মা সাহিদা বেগমকে নিয়ে বসবাস করত। গতকাল সন্ধ্যার দিকে পুলিশ কয়েক দফায় বাসায় অভিযান চালায়। এছাড়াও গভীর রাতে র্যাবের একটি দল বাসায় তল্লাশী চালিয়েছিল। ধানসীড়ি সড়কের রিফাত ফরাজীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির মুল ফটক ও বাসার দড়জা তালাবদ্ধ। ওই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সকালে ঘরের দড়জাও তালাবদ্ধ তারা বাড়ির গেট ভেতর থেকে আটকানো দেখতে পান। ধানসীড়ি সড়কের কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নয়নের এলাকাবাসী ও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, নয়ন ও রিফাত দীর্ঘদিন ধরে নানা অপরাধে জড়িত থাকলেও ভয়ে মুখ খুলতোনা কেউ। বারবার আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ত এই চক্র। গত বুধবার রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রিফাত ও নয়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করে ভুক্তভোগীরা। মূল নাম নয়ন হলেও কর্মকাণ্ডের জন্য হলিউড তারকা বন্ডের নাম জুড়ে হয়েছেন নয়ন বন্ড। সহযোগী রিফাত ফরায়েজীসহ একটি গ্রুপ তৈরি করে ধানসীড়ি সড়ক থেকে শুরু করে শহরজুড়ে নয়ন অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল নয়ন। বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে ফের অপরাধে তৎপর হয় নয়ন ও রিফাত। চুরি ছিনতাই লুটপাট, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে উভয়ের বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি সড়ক, কেজিস্কুল ও ধানসীড়ি সড়কে মূলত নয়নের বিচরণ ছিল। ছিনতাই, ছাত্রদের মুঠোফোন জিম্মি করে টাকা আদায়, ছোটোখাটো মারধের থেকে তার অপরাধ প্রবনতা শুরু হলেও ২০১৭ সালে পুলিশি অভিযানে নয়নের কলেজ রোডের বাসা থেকে বিপুল পরিমান মাদকদ্রব্যসহ আটক করে পুলিশ। এরপরই নয়ন নামটি লাইমলাইটে চলে আসে। ওই মামলায় জামিনে আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে নয়ন। এরপর সে নিয়মিত মাদকব্যবসায় জড়িয়ে যায় এবং রিফাতকে সাথে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরী করে। এই গ্রুপের বড় ভাই নয়ন ও তার সহযোগী হিসেবে রিফাত ফরায়েজী ও তার ছোটভাই রিশান ফরায়েজি কাজ করত। এদের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাই ও ছাত্রদের ম্যাচে ঢুকে মুঠোফোন কেড়ে নেয়া অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক যখম করেন রিফাত ফরাজী। মিন্নির কান্না ওই ঘটনা ভুক্তভোগী তরিকুল জানান, একদিন সামান্য কথা কাটাকাটি হয় রিফাত ফরাজীর সঙ্গে তার। তখন রিফাত ফরাজী তাকে কুপিয়ে যখম করার হুমকি দেন। রিফাত ফরাজীর ভয়ে তিনি দেড় মাস রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে তার বাসায় যাওয়া আসা করতেন। হুমকি দেয়ার দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন সন্ধ্যায় রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে তরিকুল তার বাসায় যাওয়ার পথে রিফাত ফরাজী দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তার মাথায় গুরুতর যখম করেন। এ ঘটনায় তরিকুলের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। একই বছর রিফাত বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রদের জিম্মি করে, তাদের ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করেন। এ বিষয়ে ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ‘ডিকেপি রোডের আমাদের ভাড়া দেয়া বরগুনা পলিট্যাকনিক ইনিস্টিটিউটের মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করেন রিফাত ফরাজী। এ ঘটনা জানার পর আমি বরগুনা সদর থানায় গিয়ে অভিযোগ করায় রিফাত ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। পরে তিনি রিফাতের কাছ থেকে ছিনতাই করা ১৪টি মোবাইলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার করেন। আর বাকি তিনটি মোবাইল উদ্ধার করতে না পেরে নতুন মোবাইল কিনে দিয়ে থানা থেকে মুক্তি পান।’ নয়ন চিহ্নিত অপরাধীতে পরিনত হলেও অজ্ঞাত কারণে তাঁেক জেলে বেশীদিন আটক থাকতে হয়নি। এদিকে এ ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বৃহষ্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। শীঘ্রই নয়ন রিফাতসহ অন্যদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন তিনি। ![]() রিফাত বৃহস্পতিবার দুপুরে বরগুনা সরকারি কলেজে ক্যাম্পাসে রিফাত শরীফ হত্যার বিচার চেয়ে মাববন্ধন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। এসময় শিক্ষার্থীরা কলেজ এলাকায় প্রকাশ্যে এভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় শঙ্কা প্রকাশ করে প্রশাসনের কাছে কলেজ এলাকায় নিরাপত্তা দাবি করেন। এছাড়াও রিফাত হত্যার ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শহরের প্রেসক্লাবের সামনে আরও একটি মানবন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। এতে রিফাতের সহপাঠি ও বন্ধুরা অংশ নেন। বেলা তিনটার দিকে নিহত রিফাতের মরদেহ তার নিজ বাড়ি বড় লবনগোলায় নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হলে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বাস আসর তার নামাজ বাদ তাঁর নিজ বাড়িতে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে। এমএমএম/এইচএস |