বিভিন্ন স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মেরামত ও সংস্কারের নামে প্রতি অর্থবছরেই রাজশাহী চিনিকলের লাখ লাখ টাকা লোপাট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেনায় জর্জরিত রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর মেরামত ও সংস্কারকাজে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।
তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না বলে জানিয়েছেন চিনিকলটির শ্রমিকেরা। তাঁদের দাবি, কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে এই চিনিকল।
গত ২৪ মার্চ চিনিকলের সহকারী ব্যবস্থাপক (সিভিল) সামিউল ইসলাম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামকে মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পর থেকে শ্রমিকেরা চিনিকলের অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেন। তাঁরা জানিয়েছেন, চিনিকলের সহকারী ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল বাশার সংস্কারের অর্থ লুটপাট করে যাচ্ছেন।
চিনিকল থেকে প্রকাশিত ২০২২-২৩ মৌসুমের কার্য সম্পাদন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই মৌসুমে ৭৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৬১ টাকার মেরামত ও সংস্কারকাজ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, মিলের মৌসুমি ব্যারাক মেরামত ও সংস্কারে ব্যয় করা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৩৭৮ টাকা ৫৬ পয়সা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, চিনিকলে মোট পাঁচটি ব্যারাক রয়েছে। সব কটিই বসবাসের অনুপযোগী। একটি ব্যারাকের ওপরে টিন পর্যন্ত নেই। এই ব্যারাকগুলোতে অনেক দিন কোনো সংস্কারকাজ হয়নি। কর্তৃপক্ষ কোনো সংস্কার করে না বলে এক শ্রমিক নিজের টাকায় একটা ব্যারাকের দরজার অংশটি সংস্কার করেছেন। জরাজীর্ণ ব্যারাকের একটি কক্ষে তিনি থাকেন।
কার্যসম্পাদন প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এমডির বাংলোর পুকুরের পাড় বাঁধাইয়ে ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, পুকুরের তিন পাড় বাঁধাই করা হয়েছে। একদিকের পাড় এখনো বাঁধাই করা হয়নি। শ্রমিকেরা জানান, গত মৌসুমে শুধু দক্ষিণ পাড়ের প্রায় ১০০ মিটার বাঁধাই করা হয়েছে। এতেই ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এই কাজ করতে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা খরচ হওয়ার দাবি তাঁদের।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারখানার ভেতরে ১০ হর্স পাওয়ারের ৬০ হেড সাবমার্সিবল পাম্প বসাতে খরচ করা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৮৪১ টাকা। অথচ ১০ হর্স পাওয়ারের দাম বাজারে দেড় লাখ টাকা। আড়াই লাখ টাকায় এটি স্থাপন সম্ভব। একটা হ্যামার ড্রিল কেনার বিল দেখানো হয়েছে ১৯ হাজার ৮৮৯ টাকা। অথচ বাজারে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায় হ্যামার ড্রিল মেশিন পাওয়া যায়। ভাটুপাড়া ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রের সংস্কারে দেখানো হয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার টাকা। বাস্তবে সেখানে কোনো কাজই হয়নি বলে শ্রমিকেরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া কার্য সম্পাদন প্রতিবেদনে সবকিছুর অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানো হয়েছে বলে শ্রমিকদের দাবি।
সরেজমিনে চিনিকলের ভেতরের রাস্তাগুলো একেবারেই ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ভেঙে গেছে সীমানাপ্রাচীরও। শ্রমিকেরা জানান, বছর দেড়েক আগে রাস্তাগুলো সংস্কার করা হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে। তাই এখনই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকদের অভিযোগ, এমডি আবুল বাশার প্রকৌশলী সামিউলের কাছ থেকে সুবিধা পান। তাই তাঁর নানা অনিয়মের ব্যাপারে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেন না।
এসব নিয়ে জানতে চাইলে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে আমার একটা ঘটনা ঘটেছে। এখন তারা এসব অভিযোগের কথা বলবেই। বাস্তবে এসবের কোনো সত্যতা নেই। অভিযোগ তুললেই হবে না, অভিযোগের প্রমাণও থাকতে হবে।
ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে কোনো কাজের চিত্র না পাওয়ার কয়েকটি উদাহরণ দিলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী চিনিকলের এমডি আবুল বাশার বলেন, সব কাজ টেন্ডার বা কোটেশনের মাধ্যমে হয়। তদারকি কমিটিও থাকে। কাজ কেমন হয়েছে, তা কমিটির লোকজন বলতে পারবে। আমি তো সবকিছু দেখি না। তিনি দাবি করেন, সব কাজ সুন্দরভাবেই হয়। কোনো অনিয়ম হয় না।
গেল মৌসুমের কার্যসম্পাদন প্রতিবেদনে ব্যারাকের সংস্কার বাবদ অর্থ ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে কোনো কাজ না করার বিষয়ে এমডি বলেন, আমি আসার পরে ব্যারাকে কোনো সংস্কার হয়নি। দুই বছর আগে আমি যখন ছিলাম না, তখন কাজ হতে পারে। কার্য সম্পাদন প্রতিবেদনে ব্যারাকের সংস্কার বাবদ অর্থ ব্যয় দেখানো ঠিক নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এমবি