For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

প্রাথমিকে নিয়োগ পরীক্ষা দেয়ার ৪০ বছর পরে যোগদানের চিঠি

Published : Saturday, 20 January, 2024 at 7:23 PM Count : 320


প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরির জন্য যখন আবেদন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দীনবন্ধু ভট্টাচার্য তখন তিনি যুবক। বহু কাঠ-খড় পোড়ানোর পর অবশেষে বৃহস্পতিবার এসেছে সেই বহুপ্রতীক্ষিত চাকরির চিঠি। দীনবন্ধু ভট্টাচার্যের বয়স এখন ৬৪।

আশির দশকের কথা। প্রাথমিক শিক্ষকের পদে চাকরির জন্য পরীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ হয়নি বলে অভিযোগ। দায়ের হয় মামলা, তবে সুরাহা হয়নি। অবশেষে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পর নিয়োগের চিঠি এসেছে বটে। কিন্তু তার মাঝেই পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় ৪০ বছর।

দীনবন্ধু ভট্টাচার্য একা নন, তার মতো আরো ৬২ জন রয়েছেন, যারা দীর্ঘ লড়াইয়ের পর চাকরির চিঠি পেয়েছেন বটে। কিন্তু তারা ‘অবসর নেয়ার’ বয়সসীমা অতিক্রম করেছেন।

চাকরির চিঠি হাতে পেয়ে কী করতে হবে প্রথমে বুঝতেই পারেননি দীনবন্ধু ভট্টাচার্য।


বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষকের জন্য যখন পরীক্ষা দিয়েছিলাম তখন আমি যুবক। সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে এখন আমার বয়স ৬৪। গতকাল হাতে অ্যাপয়েন্টমেন্টের চিঠি পেয়েছি। আমি একা নয়, আমার মতো ৬৬ জন এই চিঠি পেয়েছে। এর মধ্যে চারজন তো বেঁচেই নেই।’

চিঠি হাতে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন, পান্ডুয়ার চক্র বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিসে। তার মতো আরো একাধিক ব্যক্তিই ছুটে যান সেখানে, চিঠির ‘মর্মার্থ বুঝতে’।

নিয়োগ সংক্রান্ত এ মামলাটি যে সময় দায়ের হয় তখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল বামেরা।

বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ক্ষমতায় রয়েছে। গত কয়েক বছরে শিক্ষক নিয়োগ, পৌরসভায় নিয়োগ, রেশন-সহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে খবরের শিরোনামে রয়েছে এই রাজ্য।

নিয়োগের দাবিতে রাস্তায় বসে আন্দোলন করছেন নবম-দশম এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির চাকরিপ্রার্থীরা। অভিযোগ, ২০১৬ সালে এই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়।

কিন্তু প্যানেলের তালিকাভুক্ত হয়েও এই চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ হয়নি। তাদের আন্দোলনের সময় পেরিয়েছে এক হাজার দিনেরও বেশি সময়।

চাকরির পরীক্ষা পাশ করেও চাকরি না পাওয়ায় দ্বারস্থ হয়েছেন আদালতের। এরপর একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসে। চাকরি কিন্তু এখনো মেলেনি তাদের, কখনো মিছিল করেছেন, কখনোবা প্রতিবাদে মাথা মুড়িয়েছেন।

এদিকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তার ঘনিষ্ঠদের গ্রেফতার করা হয়। একইসাথে গ্রেফতার করা হয়েছে শিক্ষা দফতরের একাধিক কর্মকর্তাকেও।


এরই মধ্যে হুগলি জেলা পরিষদের এই শিক্ষক নিয়োগের চিঠিকে ঘিরে আরো একবার তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি।


ঘটনা প্রবাহ

বাম আমলে ১৯৮৩ সালে শিক্ষক নিয়োগের চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলেন দীনবন্ধু ভট্টাচার্য, অচিন্ত্য আদক, কালীধন বন্দ্যোপাধ্যায় মতো আরো অনেকেই। চাকরির জন্য ইন্টার্ভিউও হয়েছিল সে বছর।

‘তখন আমার বয়স ২৭-২৮ হবে। প্রাথমিক শিক্ষকের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ইন্টার্ভিউয়ের পর আমাদের নির্বাচনও হয়, কিন্তু সেই প্যানেল বাতিল হয়ে যায়। আমরা সেই বছরই আদালতের দ্বারস্থ হই। সমস্ত কিছু বিক্রি করে এতদিন সেই মামলা চালিয়েছি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন কালীদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

তিনিও প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের চিঠি পেয়েছেন হুগলি জেলা পরিষদের কাছ থেকে।

নিয়োগ সংক্রান্ত ওই মামলা চলছিল কলকাতা হাইকোর্টে। দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলে। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের আগস্ট মাস থেকে তাদের চাকরিতে নিয়োগ করার কথা বলে আদালত।

‘১৯৮৩ সালে জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং দেয়া হতো। ওই বছর সারারাজ্য জুড়ে যে নিয়োগ হয়, সে সময় কেউ কেউ নিযুক্ত হয়েছেন, কেউবা হননি। সে সময় নিয়ম ছিল ৬০ শতাংশ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেয়া হবে এবং বাকি যাদের প্রশিক্ষণ নেই। কিন্তু যোগ্য তাদের নেয়া যেতে পারে,’ বলেছেন রাজ্যের নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহন দাস পণ্ডিত।

তার কথায়, ‘অন্যদিকে মামলাকারীদের দাবি ছিল, যারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাদের সবাইকে প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করতে হবে। এই দাবি জানিয়ে তারা আদালতের দ্বারস্থ হন, মামলা চলতে থাকে। ‘


‘৩০ বছর পর ওই মামলার যে রায় বের হয় ২০১৪ সালে সেটা রাজ্য সরকার মানতে চায়নি, তাই সেই মামলা আবারো চলতে থাকে। অবশেষে ২০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট নির্দেশ দেয় চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগের। কিন্তু রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানোই হয়নি আবেদনকারীদের বয়সসীমা ৬০ অতিক্রম করেছে এবং চারজন বেঁচে নেই।’

তিনি আরো প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষা দফতরের অনুমোদন ছাড়া কিভাবে জেলা পরিষদের নিয়োগের চিঠি পাঠায়।

‘রাজ্য সরকারের উচিত ছিল খোঁজখবর নিয়ে আদালতকে সঠিক তথ্য দেয়া। সেটা তারা করেনি। বরং রাতারাতি নিয়োগের চিঠি পাঠিয়েছে,’ বলেছেন তিনি।

এ বিষয়ে অবশ্য বিশেষ মন্তব্য করতে চাননি হুগলি জেলা পরিষদের কেউ।

নিয়োগপত্রে সই রয়েছে হুগলি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারপারসন শিল্পা নন্দীর। জেলা পরিষদের তৃণমূলের সদস্যের দাবি, আদালতের রায় সংক্রান্ত নথিতে নাম ঠিকানার উল্লেখ থাকলেও বয়সের কথা বলা নেই।

অন্যদিকে মন্তব্য করতে চাননি তৃণমূলের ওই জেলা পরিষদের সদস্য সুবীর মুখোপাধ্যায়ও।

তিনি বলেন, ‘কোর্টের নিয়োগ সংক্রান্ত রায় অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।’

'বন্ধু তো মরেই গেল'

‘আমি সর্বশান্ত হয়ে গেছি। চাকরির অপেক্ষা করতে করতে আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে। মামলা লড়তে আর অন্যান্য খরচ চালাতে গিয়ে আমাদের এক বিঘা জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন থাকি বৃদ্ধা মায়ের সাথে। ভেবেছিলাম ছাত্র পড়াব, এখন লোকের জমিতে চাষ করে খাই। তবু আমরা অন্তত বেঁচে আছি, বন্ধু তো মরেই গেল,’ আক্ষেপ করেন দীনবন্ধু ভট্টাচার্য।

হুগলি জেলা পরিষদের নিয়োগপত্র অনুযায়ী এখন তার যোগ দেয়ার কথা কাছের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

তিনি বলেছেন, ‘উমেশ তালুকদার, সইদুল হালদার, স্বপন ঘোষ-সহ তিনজনকে হারিয়েছি আমরা। অনেকেরই সংসার ভেসে গিয়েছে।’

একইকথা জানালেন খন্যানের অচিন্ত্য আদক। ‘আমার যোগ দেয়ার কথা বাণী মন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চিঠি পাওয়ার পর আমিও যোগাযোগ করেছিলাম।’

নিজের আর্থিক অবস্থার কথা জানিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন অচিন্ত্য হালদার। তিনি বলেন, ‘খুব অভাবের সংসার। আমি আর আমার বৌদি থাকি। দাদা চাকরি করত। তিনি বেঁচে থাকতে কিছু একটা করে চলত। উনি মারা যাওয়ার পর খুব কষ্টে চলে আমাদের। মামলা চালাতে গিয়ে অর্থ গিয়েছে, আর জীবনের অর্ধেকটা তো চলেই গেল। আমার বয়স ৬৮ পেরিয়েছে।’

রাজনৈতিক বিতর্ক

এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিতর্ক এখন তুঙ্গে। বিজেপির হুগলি জেলার প্রেসিডেন্ট স্বপন পাল বলেছেন, ‘একের পর এক দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে খবরের শিরোনামে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করেছে তৃণমূল সরকার?’

যারা নিয়োগের চিঠি পেয়েছেন, তাদের পক্ষ নিয়ে বর্তমান সরকারকে দিকে আঙুল তুলেছেন তিনি। তার কথায়, ‘৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর চাকরির চিঠি পাওয়াটা প্রহসন ছাড়া কী! কেউ মারা যাওয়ার পর তার পরিবারের হাতে যদি নিয়োগের চিঠি এসে পৌঁছায় তা হলে তার মানসিক পরিস্থিতি কী হয়? এটা কী তার পরিবারের দুর্বল জায়গায় আবার আঘাত করা নয়?’

তৃণমূলের চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য তোপ দেগেছেন বাম সরকারের ওপর। তিনি বলেন, ‘এটা তো বাম জমানার কথা। তারা জবাব দিক। যত দোষ আমাদের?’

অন্যদিকে, সিপিএম-এর সুজন চক্রবর্তীও প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূলের দিকে। তার কথায়, ‘যাকে নিয়োগ করা হচ্ছে তার বয়স কত এবং তিনি বেঁচে আছেন কি না সেটাও এদের খোঁজ নেয়ার দরকার নেই। লুট আর দুর্নীতিটা এত ভয়াবহ যে কিছু বলার নেই। শুধুই গোঁজামিল দেয়ার চেষ্টা।’

সূত্র : বিবিসি

এমবি

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,