কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। শুধু এই সরল বিশ্বাসের কারণে মানুষ প্রতিদিন ভিড় করছেন ময়মনসিংহের ভালুকার এক কবিরাজ বাড়িতে। প্রতিদিন শত শত মানুষের ভীড়। কেউ এসেছেন রোগ থেকে মুক্তি পেতে, কেউ জ্বীন-ভূত তাড়াতে। নিঃসন্তান দম্পত্তি এসেছেন সন্তান লাভের আশায়। তবে এখানে আসা সবার হাতেই কিছু না কিছু রয়েছে। তেল, কবুতর, মুরগী, পানিসহ অনেক কিছু। এগুলো সবই কবিরাজি উপকরণ। এগুলো দিয়েই চলে কবিরাজ সবুজ মিয়ার চিকিৎসা।
ভালুকার রাজৈ ইউনিয়নে সবুজ মিয়ার এই আখড়ায় শুধু আশপাশের নয়, দূর থেকেও বহু লোকজন আসেন। আদৌ কি তাদের কেউ সুস্থ হয়েছেন এখানে এসে? এমন প্রশ্নের জবাবে রমিজ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, 'লোকমুখে শুনে এখানে আসা। তার দেয়া তদবিরে কাজ হবে কি হবে না বিষয়টি এমন নয়। মানুষের মুখে শুনে এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি।'
এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা জানান, এই কবিরাজ কবিরাজির জন্য কোন টাকা পয়সা নেয় না। চিকিৎসা নিতে সঙ্গে আনতে হয় শুধু তেল, পানি, কলম, মুরগি, কবুতর, মোমবাতিসহ আরও অনেক কিছু।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম থেকে আসা এক ব্যক্তি বলেন, 'চিকিৎসা পেয়ে ভালো হয়েছে এমন একজনের কথায় এই কবিরাজ বাড়িতে এসেছেন তিনি।'
সরেজমিনে কবিরাজ বাড়িতে দেখা যায়, স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন যুবক। তারাই শৃঙ্খলা রক্ষাসহ অন্য সব দিক দেখভাল করেন।
কবিরাজ সবুজ মিয়ারও দাবি, তিনি কোন ফি নেন না। তিনি বলেন, 'তেল-পানি যে যে নিয়তে আনে, তার সেই নিয়ত পূরণ হয়।'
এই কবিরাজি কিভাবে শিখলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'এই তদবির মানুষের দেওয়া কোন জিনিস নয়, আল্লাহর দেওয়া জিনিস। আধ্যাত্মিক ভাবে আমাকে তা দেওয়া হয়েছে। এমন ভাবে তদবিরটি দেওয়া হয়েছে যে আমলের পরিবেশে অবসর সময়ে মানুষের সেবা করতে হবে।'
যদি কারও বিয়ে-শাদী, যাদু-টোনা করা থাকে তারাও এখানে এসে সুস্থ হন বলে দাবি করেন তিনি।
কবিরাজ সবুজ মিয়া বলেন, 'আমি নিঃস্বার্থে আখেরি নবীর উম্মাতের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছি। এছাড়াও এখানে করা হচ্ছে জিন-ভূতের আছর ধরা রোগীদের সেবা।'
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে সবুজ মিয়ার কবিরাজির কারিগরি শুরু। পরে স্থানীয় প্রশাসন এই আস্তানাটি বন্ধ করে দেয়। এর কিছুদিন পর মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে আবারও শুরু হয় সবুজের কবিরাজি।
শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অফ ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন অবজারভার অনলাইনকে বলেন, 'বর্তমান সমাজে কিছু কিছু জায়গায় ঝাড়-ফুঁক, ভাগ্য গণনা, রাশিফল এখনও প্রচলিত আছে। ভাগ্য গণনা, রাশি ফল, জাদু টোনা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না।'
ইসলামিক দিক দিয়ে ঝাড়-ফুঁকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'একটি আছে শিরক যুক্ত ঝাড়-ফুঁক অন্যটি হলো শিরক মুক্ত ঝাড়-ফুঁক। যে সকল ঝাড়-ফুঁক কোরআনের আয়াত ও শরীয়া সম্মত সেগুলো হলো শিরক মুক্ত ঝাড়-ফুঁক। আর মুরগী দেয়া, কবুতর ছাড়া, মোমবাতি জ্বালিয়ে চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে থাকা এগুলো শিরক যুক্ত। এগুলো নিতান্তই ভন্ডামি ছাড়া কিছুই না। ব্যক্তি উদ্দেশ্যে লাভবান হওয়ার আশায় অনেকে এগুলো করে থাকে। এগুলো ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না।'
রাজধানীর উত্তরার উইমেন এন্ড চিলড্রেন হসপিটালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. ফয়সাল আল সামস মালিক অবজারভার অনলাইনকে বলেন, 'কবিরাজদের এই ঝাড়-ফুঁক বিজ্ঞান সম্মত নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোন ভিত্তি নেই। তেল পড়া, পানি পড়া, তাবিজ-কবজ কাউকে সুস্থ করে তোলে না। এটা পুরোপুরি মানুষের অন্ধ বিশ্বাস। যারাই এগুলো করছে তারা সাধারণ মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসা করছে মাত্র।'
-এমএ