দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক যৌন হয়রানীকারী মো. রমজান আলীকে বহিষ্কারের দাবীতে হাবিপ্রবি’র ভাইস চ্যান্সেলর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দিনাজপুর জেলা শাখা। স্মারকলিপি গ্রহণ করেন হাবিপ্রবি’র ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মু. আবুল কাসেম।
বুধবার (১২ জুন) দুপুরে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দিনাজপুর জেলা শাখার সভাপতি কানিজ রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ড. মারুফা বেগম স্বাক্ষরীত স্মারকলিপিতে বলা হয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিষ্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মো. রমজান আলীর বিরূদ্ধে গতবছর ১৬ জানুয়ারী তার স্ত্রী রেজিষ্টারের নিকট লিখিত অভিযোগ করেন।
লিখিত অভিযোগে রমজান আলীর স্ত্রী উল্লেখ করেন, রমজান আলী প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করা অবস্থায় সেখানে এক ছাত্রীর সঙ্গে ফেসবুক এবং মুঠোফোনে যোগাযোগ করতেন। পরে রমজান আলী হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এরপরই নিজ তত্ত্বাবধানে ওই ছাত্রীকে সেখানে ভর্তি করাতে চান। বিষয়টি জানতে পেরে এতে বাঁধা দিলে স্ত্রীকে নির্যাতন শুরু করেন রমজান আলী। পরে স্ত্রীর কাছে গোপন করে ওই ছাত্রীকে নিজ তত্ত্বাবধানে হাজী দানেশে ভর্তি করান। এরপর স্ত্রী দিনাজপুরে যেতে চাইলে রমজান আলী তাকে নিয়ে আসেননি।
স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে রমজান আলী নিজের তত্ত্বাবধানে থাকা এমএস কোর্সের এক ছাত্রীকে বিভিন্ন অযুহাতে বাসায় যেতে চাপ দিতে থাকেন। এমনকি বাহিরে গিয়ে হোটেলে এক রুমে থাকার জন্যও চাপ দেয়। এতে রাজী না হলে ওই ছাত্রীকে শাসান এবং পরীক্ষায় ফেল করে দেওয়ার হুমকি দেয়। ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই রমজান আলীর বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক চেষ্টার জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগ এনে বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়।
লিখিত অভিযোগের সঙ্গে রমজান আলীর মুঠোফোনে কথোপকথনের রেকর্ড জমা দেয়। এছাড়াও রমজান আলী যৌতুকের জন্য তাঁর স্ত্রীকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনায় রমজান আলীর স্ত্রী রাজশাহী আদালতে মামলাও করেন। মামলাটি চলমান রয়েছে।
ওই ছাত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ছাত্রীর অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ওই বছর ২৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু সে সময় প্রশাসন রমজান আলীকে নীতি বিবর্জিত শিক্ষক উল্লেখ করলেও অজ্ঞাত কারণে শুধুমাত্র কঠোরভাবে সতর্ক করে এমএস ডিগ্রি তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব থেকে এক বছরের জন্য অব্যহতি দেয়।
রমজান আলীর স্ত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যলয়ের সোসাল সায়েন্স এন্ড হিউম্যানিটিস অনুষদের ডিন ফাহিমা খানমকে আহবায়ক এবং সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আশরাফী বিনতে আকরামকে সদস্য সচিব করে গঠিত যৌন নির্যাতন অভিযোগ গ্রহনকারী কমিটিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটি গতবছর ২ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
সাত সদস্যের কমিটি রমজান আলীর বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রীর দায়ের করা অভিযোগের সত্যতা পায়। সেই সাথে রমজান আলীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থলে গৃহকর্মীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রমাণও পায় তদন্ত কমিটি। তদন্তে রমজান আলীকে চিঠি দিয়ে দুবার ডাকা হলেও তদন্ত কমিটিকে অস্বীকার করে উপস্থিত হননি তিনি। এছাড়া তিনি কোন জবাবও দেননি। তদন্ত কমিটি রমজান আলীর বিরুদ্ধে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা এবং যতদিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শাস্তির বিধান নিশ্চিত না করছে ততদিন সাময়িক বহিষ্কারের সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা না নিলে মহিলা পরিষদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। মহিলা পরিষদ রমজান আলীকে বহিষ্কারের দাবিতে গতবছর ২৭ জুলাই মানববন্ধন কর্মসুচী পালন করে। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বাধ্য হয়ে গত ৩০ জুলাই রমজান আলীকে সাময়িক বহিষ্কার করে। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কথা দিয়েছিলেন তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী রিজেন্ট বোর্ডে রমজান আলীকে চুড়ান্ত বহিষ্কার করা হবে। কিন্তু আমরা আর্শ্চযের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, সাময়িক বহিষ্কারের দুই মাস দশ দিন পর গতবছর ১১ অক্টোবর রিজেন্ট বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু সেই রিজেন্ট বোর্ডের সভায় রমজানের চুড়ান্ত বহিষ্কারের বিষয়টি উপস্থাপনই করেনি প্রশাসন। কারণ হিসেবে প্রশাসন সে সময় গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলো যে, রমজান আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে ব্যক্তিগত শুনানির আবেদন করেছিলো। আইন অনুযায়ী সে শুনানি গ্রহন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষকে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। কোষাধ্যক্ষ শুনানি নিয়েছেন। শুনানির জবাব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিযুক্ত আইনজীবীর কাছে পাঠানো হয়েছে। তাঁর মতামত না পাওয়ায় সে সময় রিজেন্ট বোর্ডে রমজান আলীকে বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এর সাত মাস পর গত ২২ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় রিজেন্ট বোর্ডের সভা। কিন্তু সে বোর্ডের সভাতেও রমজান আলীর চুড়ান্ত বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নাই। বিশ্বস্ত সূত্র মতে সর্বশেষ রিজেন্ট বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রমজান আলীর বহিষ্কারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় দালিলিক তথ্য ঢাকায় না নিয়ে যাওয়ায় চুড়ান্ত বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, যেখানে দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যৌন হয়রানীর মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতেই অভিযুক্তকে সাময়িক বহিস্কার এবং খুব দ্রুততম সময়েই চাকুরিচ্যুত করেছে সেখানে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তদন্ত প্রতিবেদন পাবার পরও অভিযুক্ত শিক্ষক রমজান আলীকে বিভিন্ন ভাবে বাঁচানোর পাঁয়তারা করে যাচ্ছে।
আমরা গণমাধ্যম এবং রমজান আলীর স্ত্রীর অভিযোগে আরো জানতে পেরেছি যে, রমজান আলী স্ত্রীর দায়ের করা যৌতুকের মামলা থেকে বাঁচতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সফরের সূচী জালিয়াতি করে আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ঘটনাটি সত্যতাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উদ্বৃতি দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে যে,গৃহকর্মীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক এবং ছাত্রীকে যৌন হয়রানীর দায়ে অভিযুক্ত,যৌতুক, লোভী শিক্ষক রমজান আলী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিবির ক্যাডার। এরকম একটি রাজনৈতিক দলের ক্যাডারকে বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেনো টালবাহানা করছে? দুটি রিজেন্ট বোর্ডের সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতা টালবাহানার উৎকৃষ্ট উদাহরন।
রমজান আলীর শাস্তির সাথে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা, সুনাম সর্বোপরি নৈতিকতার মতো বিষয় জড়িত, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের টালবাহানা রাষ্ট্রপতি এবং হাইকোর্টের নির্দেশনার সাথে উপহাসের সামিল । শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয় ভাবমূর্তি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথেও বিশ্ববিদ্যালয় চতুরতা করছে বলে মহিলা পরিষদ মনে করছে।
মহিলা পরিষদ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে মনে করিয়ে দিতে চায় যে,দিনাজপুর ইয়াসমিন আন্দোলনের পূণ্যভূমি। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিনাজপুরের গর্ব। সেই গর্বের স্থানে শিক্ষকতা পেশার সাথে কোন অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী যৌন হয়রানীকারী, যৌতুক লোভী কোন ব্যক্তির ঠাই হবেনা ।
তাই অতিদ্রুত রিজেন্ট বোর্ডের সভা আহ্বান করে ও সেই রিজেন্ট বোর্ডে রমজান আলীর বহিষ্কারের এজেন্ডা প্রথম এজেন্ডা হিসেবে অর্ন্তভূক্ত এবং চুড়ান্ত বহিষ্কারের মাধ্যমে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিনাজপুরকে কলঙ্ক মুক্ত করার জন্য মহিলা পরিষদ জোর দাবী জানাচ্ছে। অন্যথায় মহিলা পরিষদ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা,ভাবমূর্তি রক্ষা তথা কলঙ্কমুক্ত করতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলবে।
স্মারকলিপি প্রদানকালে মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি মিনতি ঘোষ, সহ-সাধারণ সম্পাদক মনোয়ারা সানু, প্রশিক্ষন সম্পাদক রুবি আফরোজ, সাংগঠনিক সম্পাদক রুবিনা আক্তার, অর্থ সম্পাদক রতœা মিত্র, লিগ্যাল এইড সম্পাদক জিন্নুরাইন পারু, প্রচার সম্পাদক জেসমিন আরা প্রমুখ।
এমডিএইচ/এইচএস