উয়ারী ও বটেশ্বরে খনন করে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয় দুই যুগেরও আগে। এ লক্ষ্যে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বটেশ্বর গ্রামে জাদুঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য ২০১৩ সালে অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু গ্রামবাসীর মামলা, নকশা-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে গত ছয় বছরেও শুরু হয়নি ‘গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর’ নির্মাণ কাজ। ফলে দর্শনার্থীরা এসে এসব প্রত্নতত্ত্ব বস্তু না দেখতে পেরে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
উয়ারী-বটেশ্বর থেকে পাওয়া দুর্লভ সব নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য তিনতলা জাদুঘর ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৭ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ৩০৬ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণের নামে এই বরাদ্দ দেন। এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় জেলা পরিষদ নরসিংদীকে। জাদুঘর নির্মাণের জন্য বটেশ্বর গ্রামে তিনটি প্লটে চার বিঘা দুই কাঠা জমি বাছাই করে ঐতিহ্য অন্বেষণ। এই জমি স্থানীয় সাতজনের কাছ থেকে প্রায় ৭৫ লাখ টাকায় কিনে নিয়ে ঐতিহ্য অন্বেষণের নামে দান করেন ঐতিহ্য অন্বেষণের ট্রাস্টি, বিশিষ্ট শিল্পপতি থার্মেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মোল্লা।
উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাদুঘরের জন্য জমি বাছাই হওয়ার পর উয়ারী গ্রামের লোকজন জমি দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন জাদুঘর নির্মাণের জন্য। জাদুঘরটি উয়ারীতে নির্মাণের দাবিতে ঐতিহ্য অন্বেষণের ট্রাস্টি মুহাম্মদ হাবিবল্লা পাঠান ও ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নামে আদালতে মামলা ঠুকে দেন ওই গ্রামের ১৫ ব্যক্তি। দুই বছর পর ২০১৭ সালে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়।
নরসিংদী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আঃ মতিন ভূইয়া জানান, জমি বাছাই হওয়ার পর নকশা তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১৫ সালের নভেম্বরে। স্থপতির কাছ থেকে নকশা পাওয়ার পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) পাঠানো হয়। প্রত্যাশা ও বরাদ্দের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে ওই স্থপতি পাঁচবার নকশা সংশোধন করেন। এতে দীর্ঘ আড়াই বছর সময় লেগে যায়। এছাড়া জাদুঘরের জন্য স্থান নির্বাচন নিয়ে দুই গ্রামবাসীর দ্বন্দ্ব ও আদালতে মামলা চলমান থাকায় আরও সময়ক্ষেপণ হয়। সব সমস্যা সমাধানের পর গত মাসে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যায়। এখন দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে।
ঐতিহ্য অন্বেষণ জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বরে ছিল আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ। এখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ২০০০ সাল থেকে খননকাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৫০টি স্থান থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বেশ কিছু প্রত্নতত্ত্বতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রত্নবস্তু- ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, রোলেটেড মৃৎপাত্র, নব্যুক্ত মৃৎপাত্র, ধাতব নিদর্শন, স্বল্প-মূল্যবান পাথর ও কাচের পুঁতি, পোড়ামাটি ও পাথরের শিল্পবস্তু, বাটখারা ইত্যাদি অমূল্য প্রত্নবস্তু আবিস্কৃত হয়েছে। চুন-সুরকি নির্মিত রাস্তা, বৌদ্ধ পদ্ম-মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারিকার পাশাপাশি ইট-নির্মিত একটি বিশেষ অদ্বিতীয় স্থাপত্য বৌদ্ধকুন্ড/পুকুনিয়া আবিস্কৃত হয়েছে।
ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উয়ারী-বটেশ্বরের কামরাব এলাকার বৌদ্ধ পদ্মমন্দির ও টঙ্গীর টেকে বৌদ্ধমন্দির বাদে অন্য প্রত্নতত্ত্ব স্থানগুলো খননের পর তা মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সংরক্ষণের স্থায়ী ব্যবস্থা ছাড়া এসব প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রী প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা কঠিন। এখানকার আবিষ্কৃত প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পদের ব্যাখ্যাসহ ছবি, প্রত্নবস্তুর মডেল, রেপ্লিকা (প্রতিরূপ), প্রত্নবস্তু, প্রত্নবস্তুর আলোকচিত্র, বিবরণ ও বিশ্লেষণ প্রদর্শন করা হবে গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘরে। তখন আর দর্শনার্থীদের হতাশ হতে হবে না।
উয়ারী গ্রামে জাদুঘর নির্মাণ না করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুরো উয়ারী গ্রামের মাটির নিচে প্রত্নবস্তু ছড়িয়ে রয়েছে। তাই ওই গ্রামে জাদুঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন লেখক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ঐতিহ্য অন্বেষণের ট্রাস্টি মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। তিনি বলেন, ‘আমি জীবদ্দশায় এই জাদুঘর দেখে যেতে পারব কি না জানি না। জাদুঘরটি হলে আমার ব্যক্তিগত লাভের তো কিছু নেই, বরং জাদুঘর না থাকলে পুরো জাতির ক্ষতি হবে।’
স্থানীয় সাংসদ ও শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, দ্রুত গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘরের নির্মাণকাজ শুরু করা হবে। কী কারণে এত দিন দেরি হয়েছে, তা তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।
বিএবি/এইচএস