দিনাজপুর সেন্ট ভিনসেন্ট (মিশন) হাসপাতাল, কসবা এখন প্রসূতি মায়েদের জন্য এক কলঙ্কিত মৃত্যুপুরী। অর্থের বিপরীতে উপযুক্ত চিকিৎসা সেবার পরিবর্তে এখানে চলছে মুমূর্ষু রোগীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। তাদের স্থানীয় দালালদের দিয়ে উন্নত ও মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবার প্রলোভনে ভর্তি করানো হচ্ছে প্রসূতি মায়েদের।
ভিআইপি কেবিনের ভাড়া দিয়ে প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে সাধারণ বেডে। ১৫০ টাকা সাধারণ বেড ভাড়া একদিনের জন্য হলেও সু-চিকিৎসা না দিয়ে দিনের পর দিন রোগী আটকিয়ে রেখে প্রতিদিন ৬০০ টাকা হারে (কেবিন) ভাড়া নিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে রোগীর সর্বস্ব।
জানা যায়, গত ৫ বছর ধরে সু-চিকিৎসা না দিতে পারায় এখানে প্রতি মাসে প্রসূতি মায়ের মুত্যুর হার ঠেকেছে ৭ জনে। সম্প্রতি ৭ মে রাত ৩টায় শহরের রামনগর এলাকার প্রসূতি মা ফেরদৌস আরা লাবণ্য (২৩) এর প্রসূতি ব্যথা উঠলে ওই হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ভর্তি হন। প্রথমে সাধারণ বেডে মাত্রারিক্ত স্যালাইন প্রয়োগ করার ফলে গর্ভপাত ঘটাতে ব্যর্থ হলে রোগীর অভিভাবকদের ফুসলিয়ে কেবিনে এনে ৩ হাজার টাকা চুক্তিতে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে ওইদিন সকাল সাড়ে ৮টায় এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন সেই প্রসূতি মা।
গত ১০ মে রাত ১০টার পর অসম্পূর্ণ গর্ভপাত ঘটানোর ফলে হঠাৎ চরম খিচুনি শুরু হয় প্রসূতি মায়ের। খিচুনির ফলে হাসপাতালে মেঝেতে নিজের শরীর খামচাচে-খামচাতে নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়তে-ছিঁড়তে বেড ছেড়ে ফ্লোরে গড়াগুড়ি দিতে থাকে। এসময় দ্বিতীয় তলায় ডাক্তার ও নার্সকে ব্যাপক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে ৮৭ ঘন্টা বয়সী কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হতভাগী মা লাবণ্য।
দীর্ঘ সময়ের পর প্রসূতি লাবণ্যের মায়ের আর্তচিৎকারে দু’জন নার্স দৌড়ে আসেন। এ অবস্থায় মৃতের প্রসূতির মা মোবাইল ফোনে মৃত্যুর খবর পরিবারকে জানানোর চেষ্টা করলে সান্ট্রা নামীয় এক সিস্টার দৌড়ে এসে মৃতের মায়ের হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এবং মৃতের মাতাকে রুম থেকে বারান্দায় বের করে দেন। অপর এক সিস্টার কল্যাণী ফ্লোর থেকে মৃত লাবণ্যকে বেডে তুলে লোক দেখানোর জন্য অহেতুক প্রথমে মুখে অক্সিজেন ও হাতে স্যালাইন, ইনজেকশন পুশ করেন। এরপর রাত ১টা ৩২ মিনিটে হাসপাতাল থেকে সিস্টার নার্সরা ফোন করে লাবণ্যের ভাই মো. নূর ইসলাম নয়নকে জানান যে, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক, যে কোন মুহূর্তে বিপর্যয় ঘটতে পারে আশপাশে থাকলে রোগীর পাশে আসুন। মৃত লাবণ্যের ভাই নয়নসহ অন্যান্যরা উপস্থিত হলে লাবণ্যকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।
সিস্টার সানট্রা ও সিস্টার কল্যাণী মৃত লাবণ্যের মৃতদেহ তাৎক্ষণিক নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাইদেরকে অনুরোধ করতে থাকেন। চিকিৎসা অবহেলায় মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে কান্নায় ভারী হয়ে উঠে হাসপাতালের পরিবেশ। তাৎক্ষণিক এলাকাবাসী মিশন হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে এহেন মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতে থাকলে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সরা উপায় অন্তর না পেয়ে ওটিসহ গুরুত্বপূর্ণ দরজায় তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যায় এবং পুলিশকে খবর দেয়।
কোতয়ালী পুলিশ এসে হাসপাতালে অবস্থানরত বিক্ষুব্ধ জনতাকে ন্যায়-বিচারের আশ্বাস দিলে বিক্ষুব্ধ জনতা শান্ত হয়। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া অবস্থাতেই মৃত লাবণ্যের ভাইয়েরা স্থানীয় সাংবাদিকদের ফোন করে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে অনুরোধ করলে হাসপাতাল অফিস কক্ষে সকাল ৮টায় এসে দেখতে পান আরএমও খারিস্তাস সরেন, গণসংযোগ কর্মকর্তা নিগমানান্দ দেব, সিস্টার সানট্রা, সিস্টার কল্যাণী সেখানেই উপস্থিত রয়েছেন।
একপ্রশ্নের জবাবে তারা জানান, গত রাতে ওই হাসপাতালের ডিউটিতে মোট ছয়জন সিস্টারের উপস্থিতির কথা রেজিস্ট্রারে রয়েছে। আরএমও খারিস্তাস সরেন আরো জানান, স্ট্রোক করে রোগীর মৃত্যুর হয়েছে। ডেলিভারীর ৩দিন পর কি করে রোগীর মৃত্যু হলো জানতে চাওয়া হলে তারা কোন উত্তর দিতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর পূর্বেই প্রস্তুতকৃত ডেড সার্টিফিকেট উপস্থাপন করে বোঝানোর চেষ্টা করেন ও বলেন, দেখুন ডেড সার্টিফেকেটই উল্লেখ করা হয়েছে সে স্ট্রোক করেই মৃত্যু বরণ করেছে।
উল্লেখ্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে যে কোন রোগীর মৃত্যু হলে মৃতের স্বজনরা উপস্থিত হওয়ার পরেই ডেড সার্টিফিকেট প্রস্তুত করা হয়। এই হাসপাতালে সেই রীতি অনুসরণ করা হয়নি। তাৎক্ষণিক এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে দিনাজপুর সিভিল সার্জনের কাছে স্বজন উপস্থিতির পূর্বেই ডেড সার্টিফিকেট প্রস্তুতির রীতি রয়েছে কিনা জানতে চাওয়ার চেষ্টা করা হলে কাউকে ফোনে পাওয়া যায়নি। জেলার স্বাস্থ্যসেবার মানের দিক থেকে বিশেষ করে প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবায় অনেক বেশি পিছিয়ে পড়েছে কসবাস্থ দিনাজপুর সেন্ট ভিনসেন্ট (মিশন) হাসপাতাল বলে মনে করেন হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগীরা।
মৃতের স্বজনরা মিশন হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা দাবী করেন, অবহেলামূলক চিকিৎসার কারণে লাবণ্যের মত অকালমৃত্যুর যেন আর কোন প্রসূতির মায়ের মৃত্যু না হয়।
অবহেলামূলক চিকিৎসার কারণে লাবণ্যের অকালমৃত্যুর জন্য কসবা মিশন হাসপাতালের ঘটনাটি তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং হাসপাতাল বন্ধ সহ ব্যবস্থা নিতে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক সহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তকর্তার আশুহস্তক্ষেপ কামনা করেছেন রামনগর, মিশন রোড এলাকাসহ দিনাজপুরবাসী।
এমডিএইচ/এইচএস