সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ ৭টি উপজেলা কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ ক্রয়ের নামে ১৮ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে সংবাদ প্রচারের পর বিভাগী তদন্ত শুরু হয়েছে।
সোমবার দুপুরে খুলনা বিভাগীয় ডেপুটি ডাইরেক্টর তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. সৈয়দ জাহাঙ্গীর হোসেন, এ্যাসিসটেন্ট ডাইরেক্টর মন্জুরুল মুরশিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহাতাপ হোসেন এই তদন্ত কার্য সম্পন্ন করেন। এসময় তদন্ত দলের সঙ্গে আসেন খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা: রাশেদা সুলতানা।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ কাগজপত্র দেখে ও সার্ভে বোডের লিখিত বক্তব্য নিয়ে অনিয়মের বিষয়টি সত্য বলে মনে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কোন সিভিল সার্জন তার চেয়ারে বসে স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ বুঝে না নিয়েই বিল পরিশোধ করেছেন এবং সেটি সৎ উদ্দেশ্যে করেছেন তা প্রমাণিত হয়না। যদিও তদন্ত রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ এসব মন্তব্য করা সঠিক হবেন।
তদন্ত কমিটির ৩ সদস্যকে সঙ্গে নিয়েই খুলনা বিভাগীয় প্রধান (স্বাস্থ্য) ডাঃ রাশেদা সুলতানা সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসে আসেন। তার আসার খবরে নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ সাতক্ষীরার সদস্য সচিব হাফিজুর রহমান মাসুম ও জাসদ নেতা ওবায়দুস সুলতান বাবলুসহ সাংবাদিকরা সিভিল সার্জন অফিসে যান। তাদের সামনেই ডাঃ রাশেদা সুলতানা বলেন, তদন্ত কমিটি আমি গঠন করেছি। আমি কমিটিতে নাই। কোন নয় ছয় যাতে না হয় সেজন্য পত্রিকায় খবর পড়ে ইচ্ছে করেই এসেছি। ভালভাবে জানতে ও দেখতে। কারণ এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে গরম গরম খবর আসছে। তবে খবরের সত্যতা পেয়েছেন নানাভাবে এমনটি তিনি উল্লেখ করেই বলেন, আমি আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে প্রথমে কালিগঞ্জ ও পরে দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করেছি। ফলে সাতক্ষীরার প্রতি আমার আলাদা ভালবাসা আছে।
সব সংকট অচিরেই কেটে যাবে এমন আশ্বাস দিয়ে বলেন, দীর্ঘ এই চাকরি জীবনে আমি এমন সমস্যা দেখিনি। সরকারি মাল বুঝে পাওয়ার আগেই বিল পরিশোধ করা হয়। এ সময় তিনি আরো বলেন, আমি এখানে এসে একজনকে দেখেই বুঝেছি ঝামেলা আছে। কারণ চুয়াডাঙ্গায় থাকাকালীন সেখানেও একই প্রকৃতির অনিয়ম করেছিল ফজলুল হক। তিনি সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডাঃ রফিকুল ইসলামকে জানান, আপনি উপরে এখুনি বার্তা প্রেরণ করেন এবং এদেরকে সরিয়ে দেন, নাইলে আপনিও ঝামেলায় পড়ে যাবেন।
উল্লেখ্য, গত ১৭-১৮ অর্থ বছরে জেলায় স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ ক্রয়ের জন্য তৎকালিন সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ও স্টোরকিপার একেএম ফজলুল হক যোগসাজস করে বরাদ্দের ১২ কোটি টাকার পুরোটাই লোপাট করে। পরে একই টেন্ডারের আওতায় আবারো বরাদ্দ বাড়িয়ে মোট ১৮ কোটি টাকা গায়েব করলে গত ৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে উপসচিব হাছান মাহমুদ আকর্ষিক সাতক্ষীরায় এসে এসব যন্ত্রাংশ খোজ নিলে তা দেখাতে পারেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় আঞ্চলিক ও জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশ হয় এবং নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ সাতক্ষীরার নেতৃবৃন্দ জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। তারা ২৩ এপ্রিল সিভিল সার্জন অফিস ঘেরাও ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যান বরাবর স্মারক লিপি প্রদানের ঘোষনা দিয়ে সপ্তাহ ব্যপি পথসভা করেন। নির্ধারিত দিনে সরকারি অর্থ আত্মসাৎকারি চক্রটির কালো টাকার ভাড়াটিয়া কথিত ভূমিহীন নামধারিদের ভাড়া করে একই দিনে একই স্থানে আরও একটি মানববন্ধনের ঘোষনা আসে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ পরদিন ২৪ এপ্রিল স্মারক লিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। এদিন দুই ঘন্টারও অধিক সময় সিভিল সার্জন অফিসের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ। এরপর তারা প্রথমে সিভিল সার্জন ডা: রফিকুল ইসলামকে স্মারকলিপি দেন ও পরে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তদন্ত, জড়িতদের আইনের আওতায় আনা এবং শাস্তি নিশ্চিত করার দাবী জানানো হয়।
ঠিক একই দিনে দুদক খূলনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সিভিল সার্জন অফিসে এসে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করলে পরিস্থিতি বুঝে স্টোরকিপার একেএম ফজলুল হক অফিস চলাকালিন সময়ে পালিয়ে যান।
গণমাধ্যমের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে দুদক কর্মকর্তারা বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্তটিমে থাকা তরুণ কান্তি রোববার রাতে জানান, রিপোর্ট দুদকের প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। অনুমোদন আসলেই মামলা রুজু করা হবে।
এদিকে সার্বিক পরিস্থিতি বুঝে খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) পরদিন ২৫ এপ্রিল বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু ঘর্ণিঝড় ফণীর কারণে তদন্ত কাজ পিছিয়ে গিয়েছে জানিয়ে বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই কমিটির রিপোর্ট উচ্চ পর্যায়ে জমা দেয়া হবে।
এমজেআর/এইচএস