ফেনীর সোনাগাজীতে দুবৃত্ত কর্তৃক আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় এলাকাবাসী ও তার স্বজনরা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিচার দাবী করেছেন। নুসরাত এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এইচডিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
শনিবার (০৬ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৯টায় সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে বোরকাপরা কিছু মুখোশধারী তাকে ফুসলিয়ে মাদরাসার ছাদে নিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
এ ঘটনায় পুলিশ শনিবার দুপুরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একই মাদরাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আবছার উদ্দিন ও আহতের সহপাঠী আরিফুল ইসলামকে আটক করেছে। তাদের এখনও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। একইদিন বিকেলে মাদ্রাসার অফিস সহকারী মো. মোস্তফাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করলেও, রাতে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।
এদিকে মাদ্রাসাটি রোববার বন্ধ রয়েছে। শনিবার মাদ্রাসা বন্ধের কোন নোটিশও দেয়া হয়নি। যথারিতি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা সকালে এসে দেখতে পায় মাদ্রাসা বন্ধ। এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল পারভেজ মুঠোফোনে জানান, আজ আলীম পরীক্ষা না থাকায় মাদ্রাসা বন্ধ রয়েছে। তবে রবিবার দুপুরে মাদ্রাসার পারচালনা পরিচালনা পরিষদের সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, শনিবার সকালে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। মাদরাসায় পৌঁছালে এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারছে বলে ডেকে নেয়। সেখানে আরও চার-পাঁচজন বোকরাপরা ছাত্রী ছিলেন। তারা বলেন, প্রিন্সিপালের ওপর যে অভিযোগ করেছিস তা মিথ্যা, বল। এতে রাজি না হওয়ায় ওই ছাত্রীরাই নুসরাতকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
পরে তার চিৎকারে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরবর্তীতে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান।
নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান জানান, রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া চার দুর্বৃত্তই ছিল বোরকা পরা। ফলে রাফি চারজনেই কাউকেই চিনতে পারেনি। তবে এরা নারীর বেশ ধরে পুরুষও হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি। মাহমুদুল হাসান বলেন, ঘটনার পর তাঁর বোন তাঁদের এ কথা জানিয়েছেন।
মাহমুদুল হাসান অভিযোগ করে বলেন, নুসরাত কয়েকদিন আগে তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা করেছিল। সেই ঘটনার জেরে ওই অধ্যক্ষের পক্ষের শিক্ষার্থীরা তার বোনকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে।
দগ্ধ ছাত্রী সোনাগাজী পৌরসভার চরচান্দিয়া গ্রামের এ কে এম মুসার মেয়ে। তিনি এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় অধ্যক্ষ মাওলানা এএসএম সিরাজ উদ্দৌলা ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। তখন ওই ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেফতার করে এবং আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠায়।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন ধরে সোনাগাজী মাদরাসাসহ আশপাশের এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা এএসএম সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে নাশকতা, অর্থ আত্মসাৎ, শ্লীলতাহানীসহ ফেনী ও সোনাগাজী মডেল থানায় ৬টি মামলা রয়েছে।
অপরদিকে, ২০১৬ সালে দাখিল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আসার সময়ও এলাকার দুর্বৃত্তরা রাফির ওপর হামলা চালায়। সেবার মেয়েটির চোখে চুন মারা হয়। এতে রাফির ডান চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে তার ভাই নোমান জানান।
সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ঘটনাটি পুলিশ খুব গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে খতিয়ে দেখছে। এ ঘটনায় কে বা কারা জড়িত, তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে বের করা হবে।
ফেনী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এই মাদ্রাসায় একজন শিক্ষার্থীর উপর অমানবিক কাজ হয়েছে। আমি মনে করি এই সব ব্যাপারে কড়াকড়ি করা উচিত। এটা একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা, এর সুষ্ঠু বিচার হলে সামাজিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে।
এমএটিবি/এসআর